গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ক্ষমতায় ফেরাতে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে ভারত সরকার ও প্রবাসে থাকা ভারতীয় হিন্দুদের একটি উগ্রবাদী গ্রুপ। এর অংশ হিসেবে তারা ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে বহির্বিশ্বে। আর এ কাজে লুটপাটের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যবহার করছে পতিত আওয়ামী স্বৈরাচার।
সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত হওয়া ছাত্র-জনতার সরকারকে উৎখাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও পরিকল্পনা হাতে নিয়ে মাঠে নেমেছে আন্তর্জাতিক একটি হিন্দুত্ববাদী চক্র। বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্য থেকে হাসিনার দোসর হিসেবে চিহ্নিত জনবিচ্ছিন্ন একটি গোষ্ঠী, ভারত সরকার ও দেশটির ক্ষমতাশীল উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি এবং তাদের প্রবাসীরা মিলে গড়ে তুলেছে এই সিন্ডিকেটটি। পরিকল্পনা অনুযায়ী, বাংলাদেশে কোনো হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা না ঘটলেও এই তিনটি চক্র একই সুরে কথা বলছে এবং তাদের দোসর মিডিয়া তা লাগামহীনভাবে প্রচার করছে। বিষয়টি বেশ ভাবিয়ে তুলেছে দেশপ্রেমী জনতাকে।
সর্বশেষ ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত হামলার দাবি করে স্বাধীন তদন্ত করার আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে চিঠি দিয়েছে একটি ভারতীয়-আমেরিকান সংস্থা। এমনকি বাংলাদেশ ‘উগ্রপন্থী ইসলামিক রাষ্ট্রে’ পরিণত হচ্ছে বলেও চিঠিতে দাবি করেছে ভারতীয় মার্কিন হিন্দুদের সংগঠনটি। খবর টাইমস অব ইন্ডিয়ার।
ওই সংস্থাটির নাম ফাউন্ডেশন ফর ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ডায়াসপোরা (ফিডস)। এটি যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক একটি সংস্থা। বুধবার (২৭ নভেম্বর) ট্রাম্প ও বাইডেনকে পৃথকভাবে চিঠি দিয়েছেন ফিডসের প্রেসিডেন্ট খান্দেরাও কান্দ।
উল্লেখ করার মতো বিষয় হল, চিঠিতে ড. ইউনূস সরকারের আমলের মাত্র তিন মাসে ব্যাপক হারে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অত্যাচার নির্যাতন হয়েছে, এমন অনেক ভুয়া দাবি করা হয়। ফিডসের দাবি, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর দুই শতাধিক হামলা হয়েছে। যদিও এই দাবির পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ দিতে পারেনি সংস্থাটি।
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের আলোচিত যেসব ঘটনা ঘটেছে মার্কিন হিন্দুদের ষড়যন্ত্রমূলক ওই চিঠিতে সেসব ঘটনার একটিও উল্লেখ করা হয়নি। কারণ এসব নির্যাতনের ঘটনায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আমেরিকার কাছে দেওয়া নালিশে আওয়ামী লীগ আমলে এবং তাদেরই নেতাকর্মীদের দ্বারা সংঘটিত হিন্দু নির্যাতনের ঘটনাগুলি পরিকল্পিতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয় যে, ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে পুনর্বাসন করতেই হিন্দু নির্যাতনের কল্পিত কাহিনী সাজিয়ে সেটিকে ‘ট্রাম কার্ড’ হিসেবে ব্যবহার করছে চক্রটি।
ট্রাম্পকে লেখা ওই চিঠিতে খান্দেরাও কান্দ লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ও জাতিসংঘের নজরদারির আওতায় বাংলাদেশ দ্রুত একটি উগ্রপন্থী ইসলামিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হচ্ছে। এখনই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তাদের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। আমি শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে নয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার ট্রানজিশন টিমকেও অনুরোধ জানাচ্ছি যে তারা বাংলাদেশে শান্তি পুনরুদ্ধার ও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় অগ্রাধিকার দিন।
অন্যদিকে বাইডেনকে পাঠানো আরেক চিঠিতে কান্দ লেখেন, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রগতি তার সব নাগরিকের, বিশেষ করে সবচেয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠীর, অধিকার রক্ষার ওপর নির্ভর করে। আমরা বিশ্বাস করি আপনার নেতৃত্ব এই মূল্যবোধগুলোর পক্ষে থাকবে এবং যারা এখনো নিপীড়ন ও বাস্তুচ্যুতির মুখোমুখি তাদের জন্য আশা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে।
অতি সম্প্রতি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার ও তার জামিন না পাওয়া নিয়ে উভয় চিঠিতেই উদ্বেগ জানিয়েছে ফিডস।
নেটিজেনরা বলছেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের আমলে নিপুন রায়, গয়েশ্বর রায়সহ শীর্ষ অনেক হিন্দু ব্যক্তিত্বকে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে নিপীড়ন করা হয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে জোরপূর্বক দেশছাড়া করা হয়েছে। বিশ্বজিৎকে প্রকাশ্য দিবালোকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করেছে। এছাড়া রামু ও নাসিরনগরে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে উস্কানি দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। কদিন আগেও সীমান্তে দুইজন হিন্দুকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিএসএফ। এসব ঘটনায় দেশে-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করলেও মুখ খুলতে দেখা যায়নি কথিত হিন্দু অধিকারের নামে সোচ্চার হওয়া দেশ ও দেশের বাইরের এই সিন্ডিকেটকে। এসব কারণে ড. ইউনূস সরকারের আমলে হিন্দু নির্যাতনের কথিত অভিযোগ তোলাকে ষড়যন্ত্রমূলক বলে বিশ্বাস করেন দেশপ্রেমিক সচেতন মহল।
এর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ও দেশটির কংগ্রেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেষ্টা চালানো হবে বলে এক ভারতীয় হিন্দু আমেরিকান কমিউনিটি নেতা হুমকি দেন। ডাক্তার ভারত বড়াই নামে এই নেতা বার্তাসংস্থা পিটিআইকে বলেন, ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পরই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তারা কাজ শুরু করবেন।
বাংলাদেশী আমেরিকানরাও সোশাল মিডিয়ায় ফ্যাসিস্ট হাসিনাপন্থী হিন্দুদের এসব ষড়যন্ত্র প্রতিহতের ডাক দিয়েছেন। গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ্বব্যাপী যার যার অবস্থান থেকে হিন্দুত্ববাদী অপতৎপরতা রুখে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন নেটিজেনরা।
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে ভারত অযাচিত উদ্বেগ প্রকাশ করছে। অথচ ভারতের নিজের মাটিতে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর অসংখ্য নির্মমতার ঘটনা ঘটে চলেছে। সেটা নিয়ে তাদের সংকোচ বা অনুশোচনা নেই। ভারতের এই দ্বিচারিতা নিন্দনীয় ও আপত্তিকর।
শুক্রবার (২৯ নভেম্বর) নিজের ফেসবুক পেজে এক পোস্টে তিনি এমন মন্তব্য করেছেন। ভয়েস অব আমেরিকা বাংলার জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ (৬৪ দশমিক ১ শতাংশ) মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা দিতে পারছে। আমরা নিজেরাও দেখেছি, ছাত্রসংগঠন, মাদরাসা ও রাজনৈতিক দলসহ বাংলাদেশের মানুষ সাম্প্রতিক দুর্গাপূজার সময় কীভাবে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করেছে। সর্বশেষে চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে নির্মম ও উসকানিমূলক হত্যার পরও বাংলাদেশের মুসলমানরা অসীম সংযম ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তারের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারত সরকার ও দেশটির বিরোধী রাজনৈতিক দল কংগ্রেস।
সেই সঙ্গে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ‘নিরাপত্তাহীনতা’ নিয়েও দলটির পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। চিন্ময়ের গ্রেপ্তার এবং জামিন নামঞ্জুরের ঘটনায় মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে ভারতের মন্তব্যের কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে যে বিবৃতি দিয়েছে, তা সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। অত্যন্ত হতাশা ও গভীর দুঃখের সঙ্গে সরকার উল্লেখ করছে যে, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে নির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তার করার পর কিছু মহল ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। ভারতের এ ধরনের ভিত্তিহীন বিবৃতি শুধু ভুল তথ্য ছড়ানো নয়, বরং দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও বোঝাপড়া চেতনার পরিপন্থি।