20 C
Dhaka
Monday, November 25, 2024

জয়ের টাকায় ট্রাম্পের টুইট!

৫ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আর সে নির্বাচন ইস্যুতে রিপাবলিকার পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের নিন্দা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে (পূর্বের টুইটার) একটি টুইট করেছেন।

৩১ অক্টোবর বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী রাত ১১টায় পোস্ট করা সেই টুইটটিতে তিনি সবাইকে হিন্দুদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব দীপাবলির শুভেচ্ছাও জানান এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের কল্পকাহিনী তুলে ধরেন। বাংলাদেশ ইস্যুতে ট্যাম্পের এই বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্ক চলছে।

নেটিজেনদের অনেকেই বলছেন, সজীব ওয়াজেদ জয় মাসিক আড়াই কোটি টাকা দিয়ে ওয়াশিংটন ডিসির লবিং ফার্ম ‘স্ট্রেক গ্লোবাল ডিপ্লোম্যাসি’কে নিয়োগ করেছেন। সেই লবিস্ট ফার্ম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। ট্রাম্পের বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন ধারণাই নেই। মূলত জয়ের টাকায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেইক পোস্ট দিয়েছেন।

বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্পের মনগড়া বক্তব্যের রহস্য নিয়ে নেটিজেনরা নানা ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এমন কয়েকজন এ প্রতিবেদককে জানান, জয়ের নিয়োগকৃত লবিস্ট ‘স্ট্রেক গ্লোবাল ডিপ্লোম্যাসি’ হয়তো বাংলাদেশ নিয়ে এমন ফেইক তথ্য রিপাবলিকান প্রার্থীর কর্মীদের দিয়েছেন। তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইটারে এটি লিখে দিয়েছেন। এর পেছনে ভারতীয় হিন্দুদের ভোট পাওয়ার প্রত্যাশাও কাজ করছে। কারণ ট্রাম্পের প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস ভারতীয় বংশোদ্ভূত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে শেখ হাসিনা ও তার অলিগার্করা ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন।’ গতকাল এক সেমিনারে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ‘হাসিনা রেজিমে প্রতি বছর ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।’ সজীব ওয়াজেদ জয় বিদেশে পাচার করা টাকা ব্যয় করেই বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছেন।

বিসিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প তার টুইটে দাবি করেছেন, ‘বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর ‘বর্বর’ সহিংসতা চালানো হচ্ছে এবং তারা হামলা ও লুটপাটের শিকার হচ্ছেন। এসবের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ একটি সম্পূর্ণ ‘বিশৃঙ্খল’ অবস্থার মধ্যে রয়েছে।’ যদিও তার এই শুরুর বক্তব্যের সাথে একমত নন বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্য দেশের অনেক বিশ্লেষক। তবে ক্ষমতার পালাবদলের পর বাংলাদেশে যে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে সেটিও অস্বীকার করছেন না তারা। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বাংলাদেশ ও মিয়ানমার-বিষয়ক সিনিয়র কনসালট্যান্ট টম কিন ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইটের প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, তবে এগুলো মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল।’ মি. ট্রাম্প বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে কতটা অবগত, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, ‘ভারতের কিছু ডানপন্থী মিডিয়া ও রাজনীতিবিদ এই ঘটনাগুলোকে অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করেছে। তাই এটি রাজনৈতিক চাল হতে পারে। অথবা, তিনি ভুল তথ্য পেয়েছেন ও তা বিশ্বাস করেছেন।’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবিরও মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘ফিড করা হয়েছে’। অর্থাৎ, তাকে এটি বোঝানো হয়েছে। ‘নয়তো, তার এ ধরনের কথা বলার কথা না। কিন্তু বাংলাদেশের বিষয়ে যে সমস্ত শব্দ ব্যবহার করেছেন, এগুলো খুবই শক্ত শব্দ।’

দিল্লির কাছে ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করছেন বহু বছর ধরে। তিনিও এ কথা স্বীকার করেন যে, ভারতীয় গণমাধ্যমে এই ঘটনাগুলো অতিরঞ্জিতভাবে প্রচার হয়েছে। তবে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা যে ঘটেছিল সেটিও মনে করিয়ে দেন তিনি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ব্যাপারে ভারতের গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতির অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ভারতীয় গণমাধ্যম ছোট ঘটনাকে বড় করে বলে আসছে যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। চলতি সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য ধর্মকে কীভাবে ব্যবহার করা হয়, ট্রাম্পের টুইট তার সুস্পষ্ট প্রমাণ।’

এদিকে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দিল্লিতে পলাতক শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় প্রায় আড়াই কোটি টাকায় যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছেন। মার্কিন নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ওয়াশিংটন ডিসির বিশিষ্ট লবিং ফার্ম ‘স্ট্রেক গ্লোবাল ডিপ্লোম্যাসিকে’ নিয়োগ করেছেন। এই ফার্মের প্ররোচনায় ট্রাম্পের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে কর্মরতরা ট্রাম্পকে দিয়ে এই টুইট করিয়েছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের নানা ইস্যুতে লবিস্ট নিয়োগের আলোচনায় প্রায়ই সরগরম হয় রাজনৈতিক ময়দান। টানা দেড় দশক ধরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতার অভিযোগ ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে মার্কিন প্রভাব বিস্তারে লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়।

এ বিষয়ে স্ট্রেক গ্লোবাল ডিপ্লোম্যাসির চেয়ারম্যান রবার্ট স্ট্রেকের সঙ্গে চুক্তি সই করেছেন ওয়াজেদ ইনকরপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সজীব ওয়াজেদ। এতে আওয়ামী লীগের পক্ষে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাহী ও বিচার বিভাগের কাছে তুলে ধরবে প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তির মেয়াদ ধরা হয়েছে ছয় মাস। স্ট্রেক গ্লোবাল ডিপ্লোম্যাসির সঙ্গে করা তার এই চুক্তি মার্কিন বিচার বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

ফাইল ঘেঁটে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের পক্ষে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের কাছে তুলে ধরবে লবিস্ট ফার্ম। যেখানে খরচ হবে দুই লাখ ডলার। গেল ১২ সেপ্টেম্বর ছয় মাসের জন্য এই চুক্তি হয়।

এর আগে ২০০৪ সালে ‘অ্যালকাটেল অ্যান্ড ফা’ নামের এক লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে প্রথম চুক্তি করেছিল সজীব ওয়াজেদ জয়। যেখানে বলা হয়েছিল জঙ্গিবাদের প্রসারে কাজ করছে বিএনপি। ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগ তা দমন করবে। আর ২০১৯ সালে ব্লুস্টার স্ট্যাটেজিস-সহ একাধিক লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে চুক্তি করেছিল বিএনপি। তাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় গণতন্ত্র হত্যা করছে আওয়ামী লীগ।

এর আগে ২০২২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্কোন্নয়নের লক্ষ্যে মাসে ২০ হাজার ডলার চুক্তিতে এক বছরের জন্য লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছিল বাংলাদেশ সরকার। ওই সময়ের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, ‘অতি সম্প্রতি গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট রিলেশন মেনটেইন করার জন্য আমরা নেলসন মুলিন্স নামে একটি সংস্থাকে নিয়োগ দিয়েছি। ১২ মাসের জন্য নিয়োগ দিয়েছি। মাসে ২০ হাজার ডলার করে দিতে হবে।’

উল্লেখ অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনকে ব্যবহার করতে ভারতের পরামর্শে সজীব ওয়াজেদ জয় বিপুল টাকা দিয়ে ওয়াশিংটনে লবিস্ট নিয়োগ করেন। সে লবিস্টরাই বাংলাদেশ ও অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। জয়ের নিয়োগ দেয়া লবিস্ট ফার্ম ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় কাজ করছে।

উল্লেখ, তৈরি পোশাক বা যেকোনো পণ্যের বাজার ধরতে যুক্তরাষ্ট্রে অন্যতম মাধ্যম লবিস্ট ফার্ম। দেশটির বিচার বিভাগের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ ইস্যুতে অন্তত ৩৭৬টি লবিস্ট ফাইলের সন্ধান মিলেছে।

সুত্র: ইনকিলাব

সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ