ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালানোর আগে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন কি না—বিষয়টি নিয়ে আলোচনার শেষ নেই।
যদিও ৫ আগস্ট উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন বলে জানান।
এরপর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনও জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি। ’
কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপে দাবি করেন, তার মা পদত্যাগ করেননি।
তাছাড়া সরকারি বা দালিলিক প্রমাণ সামনে না আসায় বিষয়টি এখনো স্পষ্ট হচ্ছে না।
এর মধ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের এক বক্তব্য বিষয়টি নিয়ে আলোচনা আরও উসকে দিয়েছে।
সম্প্রতি মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি জানান, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন বিষয়টি তিনিও শুনেছেন। তবে তার কাছে এসংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ বা নথিপত্র নেই।
তবে সাহাবুদ্দিন এ-ও বলেন, ‘এ বিষয়ে আর বিতর্কের সুযোগ নেই। শেখ হাসিনা চলে গেছেন এবং এটাই সত্য। ’
সাক্ষাৎকারটি গত শনিবার (১৯ অক্টোবর) পত্রিকার রাজনৈতিক ম্যাগাজিন সংস্করণ ‘জনতার চোখ’- এ প্রকাশিত হয়।
সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমি বহুবার পদত্যাগপত্র সংগ্রহের চেষ্টা করেছি, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। হয়ত তার সময় হয়নি। ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে বঙ্গভবনে ফোন আসে, যেখানে বলা হয়েছিল যে প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসবেন। এর পরই বঙ্গভবনে প্রস্তুতি শুরু হয়। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যে আরেকটি ফোন আসে যে তিনি (শেখ হাসিনা) আসছেন না।
তিনি বলেন, ‘চারদিকে অস্থিরতার খবর। কী হতে যাচ্ছে জানি না। আমি তো গুজবের ওপর নির্ভর করে বসে থাকতে পারি না। তাই সামরিক সচিব জেনারেল আদিলকে বললাম খোঁজ নিতে। তার কাছেও কোনো খবর নেই। আমরা অপেক্ষা করছি। টেলিভিশনের স্ক্রলও দেখছি। কোথাও কোনো খবর নেই। এক পর্যায়ে শুনলাম, তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আমাকে কিছুই বলে গেলেন না। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার যখন বঙ্গভবনে এলেন তখন জানার চেষ্টা করেছি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন কি না? একই জবাব। শুনেছি, তিনি পদত্যাগ করেছেন। মনে হয় তিনি সময় পাননি জানানোর। ’
সব কিছু যখন নিয়ন্ত্রণে এলো তখন একদিন মন্ত্রিপরিষদসচিব এলেন পদত্যাগপত্রের কপি সংগ্রহ করতে। তাকে বললাম, আমিও খুঁজছি উল্লেখ করে মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘এ বিষয়ে আর বিতর্কের সুযোগ নেই। শেখ হাসিনা চলে গেছেন এবং এটাই সত্য। তবু এই প্রশ্নটি যাতে আর কখনো না ওঠে তা নিশ্চিত করতে আমি সুপ্রিম কোর্টের মতামত চেয়েছি। ’
মতিউর রহমানের প্রতিবেদনে জানা যায়, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে রেডিও-টেলিভিশনে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় পরিস্থিতি অস্থির থাকায় এবং সেনাপ্রধানের অনাগ্রহের কারণে তাকে ভাষণ দিতে দেওয়া হয়নি। শেখ হাসিনা তখন বলতে চেয়েছিলেন, তাকে বলপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে এবং কোন বিদেশি শক্তি তার সরকারকে উৎখাত করতে চাইছে সেটিও তিনি দেশের জনগণকে জানাতে চেয়েছিলেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট দেশে থেকে ভারতে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরই সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে, দেশ শাসনের সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব সুপ্রিম কোর্ট থেকে আসে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের শপথবাক্য পাঠ করাতে পারবেন বলে আদালত জানায়। পরে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে শপথ পাঠ করান রাষ্ট্রপতি।
দেশ ছাড়ার পর থেকে শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করছেন। পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হওয়ায় ভারত সরকার তাকে ট্রাভেল ডকুমেন্ট দিয়েছে। তবে তার রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন গুঞ্জন রয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার এবং বেলারুশের মতো দেশগুলো নিরাপত্তাজনিত কারণে তাকে আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।