28 C
Dhaka
Tuesday, June 10, 2025

নিষেধাজ্ঞা থাকায় ভুয়া প্রজেক্ট দেখিয়ে ডাটা সেন্টারে ব্যয় ৭২ কোটি

রাজধানীর বিস্তৃত এলাকাজুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহে নিয়োজিত ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিতে (ডেসকো) বছরের পর বছর ধরে চলছে দেদার লুটপাট। অবাস্তব প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্প ব্যয় কয়েক গুণ বৃদ্ধি, নিয়োগের ক্ষেত্রে চরম আত্মীয়করণ, দুর্বল ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে টাকা আত্মসাৎ, কেনাকাটায় অতিরিক্ত ব্যয়, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণসহ এহেন কোনো অবৈধ কাজ নেই, যা এই প্রতিষ্ঠানে হয়নি।

ডেসকো পরিচালনার নীতিই যেন ‘যেমন খুশি তেমন খাও’। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এই লুটপাটে নেতৃত্ব দিচ্ছে কর্মকর্তাদের একটি সিন্ডিকেট। অনেকটা প্রকাশ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি হলেও সবসময়ই নীরব ছিল বিদ্যুৎ ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। কারণ দুর্নীতিবাজ চক্রের প্রতি সাবেক মন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর আশীর্বাদ ছিল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলেও ডেসকোতে তার আঁচ লাগেনি। উল্টো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা একাট্টা হয়ে আগের মতোই লুটপাটে সহায়ক প্রকল্প পাস করাতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে যে কোনো সময় বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকের।

জানা গেছে, ‘ঢাকা পাওয়ার সিস্টেম এক্সপেনশন অ্যান্ড স্ট্রেনদেনিং’ প্রজেক্টের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এরই মধ্যে এ প্রকল্পের আওতায় কেনাকাটা বাবদ প্রায় ২শ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। নথিপত্র বলছে, এই ২শ কোটি টাকার কেনাকাটায়ও নেওয়া হয়েছে বড় অনিয়মের আশ্রয়। কোনো কোনো পণ্য দুই থেকে তিন গুণ বেশি ব্যয়ে কেনা হয়েছে।

তথ্য বলছে, আগে ডেসকোর রাজস্ব খাতের আওতায় যেসব পণ্য স্বল্পমূল্যে কেনা হয়েছিল, প্রকল্পে সেই একই পণ্য কেনা হয়েছে কয়েক গুণ দামে। এতে দেখা গেছে, প্রকল্পে স্ট্রেইট থ্রো জয়েন্টস ফর ৩৩ কেভি এক্সএলপিই, ১ কোর, ৫০০ এসকিউএমএম ইউ/জি কপার কেবলস কেনা হয়েছে প্রতিটি ১ লাখ ৪২ হাজার ৬২৩ টাকায়।

অথচ আগে এটি কেনা হয়েছিল ৫৮ হাজার ৯৫০ টাকায়। প্রকল্পের কেনাকাটায় এর দাম ১৪২ শতাংশ বেড়ে গেছে। একইভাবে স্ট্রেইট থ্রো জয়েন্টস ফর ১১ কেভি এক্সএলপিই, ৩ কোর, ৩০০ এসকিউএমএম ইউ/জি কপার কেবলস ক্রয় করা হয়েছে প্রতিটি ৭৮ হাজার ৫৪৫ টাকায়। যেটি এর আগে রাজস্ব খাতে কেনা হয়েছিল ৪৯ হাজার ৯০০ টাকায়। অর্থাৎ ৫৭ শতাংশ বেশি টাকায় এটি কেনা হয়েছে।

এ ছাড়া আউটডোর টারমিনেশন কিটস ফর ১১ কেভি এক্সএলপিই ৩ কোর, ৩০০ এসকিউএমএম ইউ/জি কপার কেবলস ক্রয় করা হয়েছে প্রতিটি ৬৩ হাজার ৪১৩ টাকায়। যেটি এর আগে ক্রয় করা হয়েছিল ৩৫ হাজার ১৫৯ টাকায়। অর্থাৎ ৮০ ভাগ বেশি টাকা দিয়ে এটি ক্রয় করা হয়েছে। শুধু উল্লিখিত পণ্যই নয়, পুরো প্রকল্পে পণ্য কেনার ক্ষেত্রে এমন ধোঁকাবাজির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।

টেস্টিং অ্যান্ড রিপেয়ারিং ডিভিশনের প্রাপ্ত তথ্যে এখানে ২৫০ কেভি উল্লেখ করলেও ছিল ২০০ কেভির। তবে এমন জালিয়াতির আশ্রয় নিলেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় ডাটা সেন্টার রয়েছে। যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে দেশের সব প্রতিষ্ঠান। এই আলোকে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে ডাটা সেন্টার তৈরি না করতে নির্দেশনা দেয় মন্ত্রণালয়।

এখানেও অর্থ আত্মসাতে চালাকির আশ্রয় নেয় ডেসকো। তারা ২০২১-২২ অর্থবছরে নেওয়া এস্টাবলিসিং ডাটা সেন্টার ফর ডেসকো প্যাকেজের নাম পরিবর্তন করে এস্টাবলিসিং মাস্টার ইনফরমেশন সেন্টার নামে ডাটা সেন্টার চালু করে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও এই প্রকল্পের নামে ব্যয় করে প্রায় ৭২ কোটি টাকা।

জানা গেছে, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ থাকলেও সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে স্কাডা প্রকল্পের আওতায় বিদেশ ভ্রমণের উৎসব করে ডেসকো। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফাইবার এট হোমের সঙ্গে এক চুক্তিতে দেখা যায়, কেবল বিদেশে ট্রেনিংয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ কোটি টাকারও বেশি।

এরই মধ্যে এই প্রকল্পের আওতায় ডেসকোর বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের নেতারা বিদেশে ভ্রমণ করেছেন। সরকারের পটপরিবর্তনের পরও ওই প্রকল্পের আওতায় বিদেশ ভ্রমণে রয়েছে আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।

নথিপত্র বলছে, ডেসকোর মামুনুর রশীদ ২০২২ সালে কানাডা, ২০২৩ সালে জার্মানি এবং ২০২৪ সালে সুইজারল্যান্ড ও জার্মানি সফর করেছেন। নন-টেকনিক্যাল কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিতভাবে বিদেশে টেকনিক্যাল প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের নামে বিদেশ ভ্রমণ করছেন।

নথিপত্র বলছে, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরও বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের সাতজন নেতা ডেসকোর টাকায় বিদেশ ভ্রমণে গেছেন। এ ছাড়া আগামী এক মাসের মধ্যে আরও অন্তত ২৫ জন প্রকৌশলী বিদেশ ভ্রমণে যাবেন, যারা মন্ত্রণালয় থেকে এরই মধ্যে অনুমতি পেয়েছেন।

এদিকে কয়েকজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে তুলনামূলক দুর্বল ব্যাংকগুলোতে ফিক্সড ডিপোজিট করেছে ডেসকো। ফলে এখন প্রয়োজনীয় টাকা তুলতে পারছে না সংস্থাটি। এর মধ্যে সিটিজেন ব্যাংকে প্রায় ১১ কোটি, পদ্মা ব্যাংকে ১৯ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংকে ২৫ কোটি, এনআরবি ব্যাংকে ৯ কোটি, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে ৬ কোটি টাকা আমানত রয়েছে।

ডেসকোর কর্মকর্তারা বলছেন, আর্থিকভাবে দুর্বল ব্যাংকে টাকা রাখার বিনিময়ে কিছু কর্মকর্তা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। কিন্তু এখন প্রয়োজনীয়তার সময় টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ এসব ব্যাংকে নগদ টাকা নেই।

এ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করায় গত এক বছরে ডেসকোর ফিক্সড ডিপোজিটের পরিমাণ ১ হাজার ৪১ কোটি টাকা থেকে মাত্র ৫৯৩ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান কালবেলাকে বলেন, ‘অনিয়ম সব জায়গায় হয়েছে। আপনারা লিখে যদি আমাদের নজরে আনতে পারেন, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব। যেসব অনিয়ম হয়ে গেছে, তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেব। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের অনিয়ম না হয়, সে বিষয়ে কঠোর তদারকি থাকবে।’

সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ