প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে সামিটের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল বন্ধের কারণে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় প্রতিদিন গড়ে ১২০০ মেগাওয়াটের মতো কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।
অন্যদিকে বকেয়ার কারণে ভারতের আদানি গ্রুপ প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়েছে। এর সঙ্গে কারিগরি কারণে বড়পুকুরিয়া কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং মাতারবাড়ী ও এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমে যাওয়ায় দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়েছে কয়েক দিন ধরে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে দিনে গড়ে সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ১৪ হাজার থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এতে প্রতিদিন লোডশেডিং হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াটের মতো।
পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম গতকাল সোমবার বিকেলে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তিন মাসের বেশি সময় ধরে সামিটের একটি এলএনজি টার্মিনাল বন্ধের কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন প্রতিদিন গড়ে ১২০০ থেকে ১২৫০ মেগাওয়াট কমেছে।
এ কারণেই মূলত বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়েছে। এর পাশাপাশি অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রে কারিগরি ও অন্যান্য কারণে যে উৎপাদন কম হচ্ছে, সেটা বড় বিষয় নয়। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল সচল হলে বিদ্যুতের যে ক্রাইসিস, সেটা মোটামুটি ওভারকাম (কাটিয়ে ওঠা) করা সম্ভব হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য কেন্দ্রের তুলনায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয় তুলনামূলক অনেক কম। এখন লোডশেডিং সামাল দিতে গিয়ে পিক-আওয়ারে ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে।’ বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৪২০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে দেশীয় ও আমদানি মিলে গড়ে সরবরাহ ক্ষমতা প্রায় ৩১০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে কক্সবাজারের মহেশখালীতে মার্কিন প্রতিষ্ঠান এক্সিলারেট এনার্জি এবং বাংলাদেশের সামিটের দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে আমদানি করা এলএনজি থেকে ১১০ কোটি ঘনফুট পাওয়া যায়।
কারিগরি ত্রুটির কারণে সামিটের এলএনজি টার্মিনালটি গত ২৭ মে থেকে বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে এক্সিলারেটের টার্মিনালের মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে ৫৯ কোটি ঘনফুট গ্যাস। এর ফলে গ্যাস সরবরাহ নেমে এসেছে ২৬০ কোটি ঘনফুটে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিদিন ২৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ হচ্ছে ৮৫ কোটি ঘনফুটের নিচে। সামিটের টার্মিনাল বন্ধের আগে ১২০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছিল।
গ্যাস সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় কলকারখানার উৎপাদনও চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য গত বুধবার সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের সঙ্গে দেখা করেন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির একটি প্রতিনিধিদল।
তারা উপদেষ্টাকে বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে কারখানায় নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ না পাওয়ায় তাদের কলকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এ সময় তারা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবি জানান।
উপদেষ্টা ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, চাহিদার তুলনায় গ্যাস সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ার কারণে এ সমস্যা হচ্ছে। শুধু ব্যবসার ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য খাতেও গ্যাস সরবরাহে বিঘœ ঘটছে, বিশেষ করে সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে। রূপসায় ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গ্যাসের জন্য চালু করা যাচ্ছে না।
তিনি জানান, সামিটের ভাসমান এলএনজি টার্মিনালটি তিন মাস ধরে বন্ধ থাকার কারণে গ্যাস সরবরাহে বিঘœ ঘটছে। ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে এটি চালুর চেষ্টা করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে গতকাল যোগাযোগ করা হলে সামিটের পক্ষ থেকে কেউ আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, টার্মিনাল বন্ধের কারণে প্রতিদিন তাদের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। টার্মিনাল সচল করতে চেষ্টার কোনো কমতি নেই। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ার কারণে কবে নাগাদ কাজ শেষ হবে, তা বলা মুশকিল।
এলএনজি সরবরাহ করতে না পারার কারণে সামিটের আর্থিক ক্ষতির কথা বলা হলেও চুক্তির শর্ত অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না করেও তাদের ঠিকই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে সরকারকে। এতে সরকারের যেমন আর্থিক ক্ষতি, অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে।
জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সামিটের টার্মিনালের পানির নিচে জটিল কাজগুলো শেষ হয়েছে। এখন ওপরের অংশে কিছু কাজ বাকি রয়েছে। আজ (গতকাল) তা শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে পুরো কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। দুই-এক দিনের মধ্যেই টার্মিনালটি সচল হবে বলে আশা করছি।’
ঢাকা এবং বড় শহরগুলোতে লোডশেডিং তুলনামূলক কম হলেও গ্রামাঞ্চলে এবং ছোট শহরগুলোতে ব্যাপক লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালক, রাইস মিলের শ্রমিকসহ বিভিন্ন খাতের ক্ষুদ্র আয়ের মানুষের আয় কমেছে। গবাদি পশুর খামারিরাও বড় ধরনের আর্থিক সংকটের আশঙ্কা করছেন বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) সদস্য দেবাশীষ চক্রবর্তী (বিতরণ ও পরিচালন) দেশ রূপান্তরকে জানান, চাহিদার তুলনায় প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ কম সরবরাহ পাওয়ায় তাদের বিতরণ এলাকায় লোডশেডিং বেড়েছে।
বর্তমানে আরইবির প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ গ্রাহক রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় সাড়ে ১০ হাজার মেগাওয়াট।
আদানিসহ তিন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমেছে : ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে গড়ে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে বাংলাদেশ। কিন্তু বেশ কয়েক দিন ধরে তারা ১ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে।
কারণ জানতে চাইলে আদানি গ্রুপের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পিডিবির কাছে তাদের বকেয়া অনেক বেড়ে যাওয়ায় কয়লা কিনতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। এ কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন কমানো হয়েছে।
তিনি আরও জানান, বকেয়া পরিশোধের বিষয়ে দফায় দফায় সরকারকে বলা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও বিল দিতে বলছে। কিন্তু সোনালী ব্যাংক থেকে অর্থ ছাড় করছে না।
ভারতীয় গণমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের উদ্ধৃতি দিয়ে সে দেশের ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের ঝাড়খন্ডের গড্ডা কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ আদানির কাছে বাংলাদেশের বকেয়া ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলার হয়েছে। এ পরিস্থিতিকে আদানি গোষ্ঠী ‘টেকসই নয়’ বলে বর্ণনা করেছে।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের কাছে পাঠানো এক বিবৃতিতে আদানি পাওয়ার বলেছে যে, আর্থিক চাপ সত্ত্বেও তারা বাংলাদেশে বিদ্যুতের নির্ভরযোগ্য সরবরাহ বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, আদানি বাংলাদেশের কাছে ৮০ কোটি ডলার পায়, তার মধ্যে ৪৯ কোটি ২০ লাখ ডলার পরিশোধ বিলম্বিত হয়েছে।
যদিও অভিযোগ রয়েছে, আদানির সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের অসম চুক্তির কারণে আর্থিকসহ নানাভাবে ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশ। ভবিষ্যতে এ ক্ষতি আরও বাড়বে।
আদানির পাশাপাশি দেশের অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রেরও বিপুল পরিমাণ অর্থ পাওনা রয়েছে সরকারের কাছে। তবে দেশীয় ওইসব কেন্দ্রের মালিকরা উৎপাদন কমিয়েছে বলে কোনো তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকে দেশে যে অর্থ সংকটের পাশাপাশি ডলার সংকট তৈরি হয়েছে, সে কারণেই মূলত দীর্ঘদিনের বকেয়া জমতে জমতে এখন তা বড় ধরনের বোঝায় পরিণত হয়েছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
কক্সবাজারের মহেশখালীতে ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বর্তমানে ৮৫০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। নতুন করে কেনাকাটার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা কয়লা কিনতে পারছেন না। সেজন্য উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুই ইউনিট পূর্ণ ক্ষমতায় কেন্দ্রটি চললে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১২ হাজার টন কয়লা লাগে। বর্তমানে প্রায় ২ লাখ টন কয়লা মজুদ রয়েছে। কেনাকাটার জটিলতা কেটে গেলে নতুন করে কয়লা আমদানি হলে বিদ্যুতের উৎপাদনও বাড়বে।
কক্সবাজারে এস আলমের এসএস পাওয়ারের ১২০০ মেগাওয়াটের যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রয়েছে, সেখানেও উৎপাদন কমে ৬০০ থেকে ৬১২ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। কেন্দ্রটির একটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ : কারিগরি ত্রুটির কারণে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে বড়পুকুরিয়া ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তৃতীয় ইউনিটটি চালু হওয়ার চার দিন পর ফের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান পার্বতীপুর প্রতিনিধি। গতকাল সকালে কেন্দ্রটির ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার তৃতীয় ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন প্রধান প্রকোশলী মো. আবু বক্কর ছিদ্দিক। এ ইউনিট থেকে দিনে ১৯০-২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়েছে।
এর আগে থেকেই কেন্দ্রটির প্রথম এবং দ্বিতীয় ইউনিট বন্ধ রয়েছে কারিগরি কারণে। তিনটি ইউনিটই বন্ধ হওয়ায় পার্বতীপুর উপজেলাসহ উত্তরাঞ্চলের আট জেলায় লোডশেডিং বেড়েছে। তবে প্রথম ইউনিটটি সপ্তাহখানেকের মধ্যে মেরামত শেষে উৎপাদনে আসতে পারে বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা। তখন সেখান থেকে ৬০ থেকে ৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।