বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ভারতের পর্যটনশিল্পে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। গত মাস অর্থাৎ জুলাইয়ের শুরু থেকে এই অস্থিরতা শুরু হয়।
বাংলাদেশের ট্যুর অপারেটররা বলছেন, গত ১ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে পর্যটন ব্যবসায়ে প্রভাব পড়তে শুরু করে।
এরপর যত সময় গেছে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে থাকে। ব্যবসায়ীরা বলেন, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর তাদের ব্যবসা তলানিতে ঠেকেছে।
বর্তমানে পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে আছে। স্থানীয় অপারেটরদের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ভারত ভ্রমণকারী পর্যটকের সংখ্যা ৯০ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের যাওয়া পর্যটকদের প্রায় এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই পর্যটকরা মূলত মেডিকেল ট্যুরিজম বা কেনাকাটার জন্য যান, বিশেষ করে দুর্গাপূজা ও বিয়ের মৌসুমে।
অপারেটররা বলছেন, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। কারণ সাময়িকভাবে ফ্লাইট বিঘ্নিত হয় এবং মেডিকেল ভিসা বাদে বেশির ভাগ ভিসা স্থগিত করা হয়।
দ্য ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যদিও এখন ফ্লাইট পুনরায় চালু হয়েছে, তবে ঢাকায় ফ্লাইট পরিচালনাকারী একটি এয়ারলাইন্সের একজন কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, তাদের ট্রিপগুলোতে যাত্রীর চাপ ৫০ শতাংশেরও বেশি কমেছে।
বাংলাদেশি ট্যুর অপারেটর কসমস হলিডে’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাব্বির আহমেদ বলেন, ভারত বর্তমানে শুধু মেডিকেল ও স্টুডেন্ট ভিসা সেবা চালু আছে।
তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগে তার এক ক্লায়েন্ট মেডিকেল ভিসাও প্রত্যাখ্যান করা হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কোম্পানির মাধ্যমে প্রতি মাসে গড়ে ৫০০ জন ভারতে যান। কিন্তু গত এক মাসে আমাদের মাধ্যমে তিনজনও যাননি।’
‘ফলে এখন ঋণ নিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালু রাখতে হচ্ছে। আমি নিজেই গত দুই মাসে ৬০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি,’ বলেন তিনি।
আরেক দেশীয় ট্যুর অপারেটর ইনোগ্লোব ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তসলিম আমিন শোভন বলেন, তার কোম্পানির ভারতে ভ্রমণকারী পর্যটকের সংখ্যা ৯৮ শতাংশ কমে গেছে।
তিনি বলেন, ‘যাদের জরুরি ভিত্তিতে ভারতে যাওয়া দরকার শুধু তারাই ভ্রমণ করছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকে প্রতিবেশী দেশটি ভ্রমণের পরিকল্পনা স্থগিত করেছেন।’
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মতে, বাংলাদেশি ভ্রমণকারীদের একটি প্রধান গন্তব্য হলো ভারত, যার পরিমাণ প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ। এর মধ্যে বেশিরভাগন ভ্রমণ করেন চিকিৎসার জন্য (প্রায় ৮০ শতাংশ), কেনাকাটা (১৫ শতাংশ) এবং অবকাশ যাপন (৫ শতাংশ)।
ভ্রমণকারীদের কেনাকাটার জন্য প্রথম পছন্দ কলকাতা। এরপর আছে সিকিম, গোয়া, কাশ্মীর, দার্জিলিং, গুজরাট, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, দিল্লি, হায়দরাবাদসহ উত্তর-পূর্ব ভারত।
ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভারতে পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছিল। কিন্তু এই পরিসংখ্যান প্রাক-মহামারি চেয়ে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ কম।
গত বছর দেশটি ৯ দশমিক ২৩ মিলিয়ন বিদেশি পর্যটক পেয়েছিল। এখান থেকে দেশটির ২৪ কোটি রুপির বেশি আয় হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে যাওয়া পর্যটকের সংখ্যা ছিল ২২ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি, যা যে কোনো একটি দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি।
ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ট্যুর অপারেটরস ওয়েস্ট বেঙ্গল চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান দেবজিৎ দত্ত বলেন, পশ্চিমবঙ্গে হাসপাতাল সংলগ্ন ট্রাভেল অপারেটর, হোটেল ও গেস্টহাউসগুলোর ব্যবসা ৯০ শতাংশ কমে গেছে।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের একজন পরিচালক বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি বিদেশগামী ট্যুর অপারেটরদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এই কারণে অনেককে ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে হচ্ছে, বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমি যদি হিসাব করি, প্রতিদিন বাংলাদেশিদের গড়ে পাঁচ হাজারের বেশি ভারতীয় ভিসা দেওয়া হয়। তাদের একেকজন যদি ভারতে ৫০ হাজার টাকা খরচ করে, তার মানে ভারত প্রতি মাসে ৭৫০ কোটি টাকা হারাচ্ছে।’