ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের ও দুর্নীতির মামলা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি (বিবৃতি) পাঠিয়েছিলেন বিশ্বের ১৬০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাদের মধ্যে শতাধিক নোবেলজয়ীও ছিলেন।
তাদের খোলা চিঠির প্রতিবাদে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস একটি প্রতিবাদী বিবৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। ওই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আলোচিত হয়েছিলেন তখনকার ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া।
এ কারণে তাকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, নানা প্রোপাগান্ডাও চালানো হয়। একপর্যায়ে জীবনের নিরাপত্তার জন্য তিনি সপরিবারে আমেরিকান দূতাবাসে আশ্রয়ও নিয়েছিলেন। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন অধ্যাপক ড. ইউনূস।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে চাকরি হারানো সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া এখনো তার চাকরি ফিরে পাননি। গত শনিবার দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। নতুন সরকারের সঙ্গে তার কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, কিংবা নতুন সরকারের কাছে তিনি আশার কথা ব্যক্ত করেছেন কি না, সে বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হয়েছে।
অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের একজন কর্মকর্তা হয়েও কেন তিনি দ্বিমত করলেন এমন এক প্রশ্নের জবাবে এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া বলেন, ‘অধ্যাপক ইউনূস স্যার বিশ্বব্যাপী সমাদৃত একজন সজ্জন ও জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের সম্পদ। তখন তার বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়া শুরু হয়েছিল, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও বিবৃতি দিচ্ছিলেন। পেশাজীবীরা বিবৃতি দিচ্ছিলেন। বিবৃতি দেওয়ার হিড়িক পড়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল, এটা আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা, ইউনূস স্যারকে বিচারিক হয়রানিতে অতিষ্ঠ করার উদ্যোগ। অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে আমাকেও বিবৃতি দিতে চাপ প্রয়োগ করা হয়। বলা হয়, বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতেই হবে।’
সাবেক এ আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘দেখুন, আমার নিজস্ব স্বাধীনতা আছে। আমি কোন বিবৃতিতে স্বাক্ষর করব এবং কোনটাতে করব না, তা একান্তই আমার। উনি নিপাট একজন ভদ্র মানুষ। উনাকে শুধু শুধু হয়রানি করা হচ্ছিল। বাংলাদেশের জনগণসহ পুরো বিশ্ব বলছিল, তাকে বিচারিক হয়রানি করা হচ্ছে। তা ছিল পুরোপুরি সত্য। ফলে আমি বিবৃতি থেকে বিরত থাকি।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন অধ্যাপক ড. ইউনূস। নতুন সরকার তাকে পদে ফিরিয়ে নিতে চাইলে তিনি কী সিদ্ধান্ত নেবেন জানতে চাইলে এমরান আহম্মদ বলেন, ‘আমি আমার বিষয়টাকে এত বড় করে দেখতে চাই না। আমাকে কোনো পদে যেতে হবে বিষয়টা এমন নয়। আমি ওকালতি পেশায় মনোযোগ দিতে চাই। আমি মনে করি এত আত্মত্যাগের পর ছাত্র-জনতার বিপ্লব যেন বেহাত না হয়ে যায়, সেজন্য রাষ্ট্রের কিছু স্বেচ্ছাসেবী পাহারাদার দরকার। আমি আমার জায়গা থেকে সেই পাহারাদারের কাজটা করে যেতে চাই। আমি হুইসেল ব্লোয়ারের কাজ করতে চাই লেখার মাধ্যমে। তবে রাষ্ট্র যদি মনে করে আমাকে প্রয়োজন, আমি সেটাকে অবশ্যই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেব।’
অধ্যাপক ড. ইউনূসের সঙ্গে বিবৃতি দেওয়ার বিষয়ে তার কোনো আলাপ হয়েছিল কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইউনূস স্যার কিংবা উনার ইউনূস সেন্টারের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না এবং ওই ঘটনার পর তারা কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।’
এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া বলেন, ‘লেবার কোর্টে মামলা চলাকালে শুধু ওনাকে হয়রানি করতে লিফট বন্ধ করে রাখা হতো। ৮০ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সী একজন বয়োজ্যেষ্ঠ সম্মানিত নাগরিককে সিঁড়ি দিয়ে ছয়তলায় উঠতে বাধ্য করা হতো। মানে বিচারিক হয়রানির সঙ্গে শারীরিক হয়রানি করা শুরু হয়। বিষয়গুলো আমার কাছে একদমই অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘বিবৃতিতে স্বাক্ষর না করার কারণে আমার ওপর দিয়ে অনেক বিপদ গেছে। আমার পুরো পরিবার হুমকির মধ্যে ছিল। আমার অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের রুম ভাঙচুর করা হয়। আমার বাসায় আক্রমণের সমূহ সম্ভাবনা ছিল। আমাকে নিয়ে প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছিল। সরকার তার সব শক্তি নিয়ে আমার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমার কাছে মনে হয় এখন আমি দ্বিতীয় জীবন পেয়েছি।’
অ্যাটর্নি জেনারেল তাকে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে বলেছিলেন জানিয়ে এমরান আহম্মদ বলেন, ‘আমি যখন পাবলিকলি জানিয়ে দিলাম বিবৃতিতে স্বাক্ষর করব না, তার পরের বিষয়ে পুরো বাংলাদেশ জানে। আমার বিরুদ্ধে সে সময়ের আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছিলেন। তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আরাফাত অকথ্য ভাষা ব্যবহার করেছিলেন। আমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হলো, এমনকি আওয়ামীপন্থি উগ্র আইনজীবীরা ফোনে হুমকি দেওয়া শুরু করলেন। আমার পরিবারের ওপর হুমকি ছিল। ভয়ানক পরিস্থিতি। বাসার সামনে সবসময় অস্ত্র হাতে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকত।’
আমেরিকার দূতাবাসে আশ্রয় নেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সেদিন ছিল শুক্রবার। সকালে আমার জুনিয়র এসে জানাল, বাসার নিচে পুলিশ নেই। আমার ছোট মেয়েকে তার আগেই নানির বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আর আমি, আমার স্ত্রী ও আমার জুনিয়র চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য রওনা দিই আমার অসুস্থ আম্মাকে দেখতে। মাঝ রাস্তায় দাউদকান্দির পর খবর পেলাম আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং নিশ্চিত খবর পেলাম যেকোনো সময় বাসায় আক্রমণ করবে আওয়ামী লীগের লোকজন। তখন বাসায় আমার দুই মেয়ে একা। খবর পেয়ে আমি গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আমার শ্যালিকাকে বলি, দুই মেয়েকে নিয়ে কানাডিয়ান হাইকমিশনের দিকে যেতে। আমি সেখানে আশ্রয় নেব। ছোট মেয়েকে তার নানির বাসা থেকে নিয়ে কানাডা হাইকমিশনের উদ্দেশে রওনা দিই। এ সময় আমার সামনে আমেরিকান দূতাবাস পড়ল। আমি সেখানেই ঢুকে পড়লাম এবং আমার মেয়েদেরও সেখানে নিয়ে আসতে বললাম।’
সে সময়ের ঘটনা তার পুরো দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে বলে জানান এমরান আহম্মদ। তিনি বলেন, আমার জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বলতে পারেন এটা আমার দ্বিতীয় জীবন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নিজেকে আরও বেশি মুক্ত মনে হয়। আমার মনে হয় সেই কালো দিনগুলো আর ফিরে আসবে না। দেশের মানুষকে সেই কালো দিনগুলো আর যেন ভোগ করতে না হয়। সেই প্রতিকূল সময়ে আমার স্ত্রী ও তিন মেয়ে খুব শক্তভাবে দাঁড়িয়েছিল। তারা আমাকে বলেছিল তুমি একটা ভালো কাজ করেছ, যা কিছুই হোক আমরা তোমার সঙ্গে আছি।’
বিগত সরকারের আমলে বিচারাঙ্গন কলুষিত করেছে যারা তারা যেন কোনোভাবে ফিরে আসতে না পারে নতুন সরকারের কাছে এ আবেদন করেন সাবেক এ আইন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তার সহযোগীরা একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রধান বিচারপতি হয়েও তিনি ছাত্রলীগের ফুল নিয়েছেন। তার সিন্ডিকেটের আইনজীবীর বাসায় দাওয়াত খেতে সিলেট গিয়েছেন। এসব বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। নতুন সরকার যেন সে উদ্যোগ নেয়। বিচারব্যবস্থা কলুষিত হলে মানুষের যাওয়ার জায়গা থাকে না। ইউনূস স্যারের কাছে আমার মিনতি বিচারব্যবস্থার হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা হোক। ইউনূস স্যার একজন ভুক্তভোগী হিসেবে নিম্ন আদালত, উচ্চ আদালতের বিচারকদের নোংরামি দেখেছেন। তিনি এসবের সংস্কার করবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।’
এমরান আহম্মদ আরও বলেন, ‘নতুন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের কাছেও আমার অনেক চাওয়া। আমার বিপদের সময় আসিফ নজরুল খুব শক্তভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সেজন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ। এ আন্দোলনে তিনি অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। নতুন প্রধান বিচারপতিও অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। আসিফ নজরুল এবং সৎ ও যোগ্য প্রধান বিচারপতির হাত ধরে বিচারব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে বলে আমি আশাবাদী।’