25.5 C
Dhaka
Wednesday, May 14, 2025

শিক্ষা খাত সংস্কারের রুপরেখা!

ফিরোজ আলম: দেশে এখন অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের শিক্ষা সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে কঠিন চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

যা করতে হবে এখন:

★ দেশের অধিকাংশ স্কুল- কলেজ ও মাদরাসার অধিকাংশ প্রধান ও সহ প্রধানগন সদ্য সাবেক সরকারের নিয়োগে গড়া।বিগত সরকারের সকল শিক্ষা বিষায়ক এজেন্ডার তারাই বাস্তবায়নককারী।তাই অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের মূল প্লেয়ারের জোরপূর্বক পদত্যাগ নয় বরং সংস্কার প্রয়োজন।তা না হলে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। পাশাপাশি সদ্য সাবেক সরকারের ত্রুটিপূর্ণ নিয়মসহ প্রাতিষ্ঠানিক রিফর্ম করা ও জরুরী।

★ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি গণতান্ত্রিক সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেখানে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকবে।
★শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয়- ব্যায়ের ভাউচার প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়ন্ত্রন করেন।এখানে ব্যাংকিং লেনদেনের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করলে আয় – ব্যয়ের দূর্নিতি ধ্বংস হবে।

★চলমান শিক্ষাক্রম একসাথেই পরিবর্তন করে অভিভাবকদের উৎকন্ঠা দূর করতে হবে।
★কমিটি প্রথা বাতিল করে শিক্ষকদের মাধ্যমে কমিটি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে।
★কিছু ক্ষেত্রে মুখস্থবিদ্যা ভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি এবং কিছু ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বিভিন্ন মাত্রার জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, চেতনা ও নৈতিকতা বিকাশের ধারাকে মূল্যায়নের আওতায় আনতে হবে।

★প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সীমিত আকারে পরীক্ষা চালু রাখতে হবে ।
★মাসিক শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে শতভাগ মূল্যায়ন চালু করা যেতে পারে। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে সামষ্টিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে।কাগজ-কলমনির্ভর পরীক্ষা যেমনি থাকবে তেমনি এসাইনমেন্ট, হাতে-কলমের কাজ ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে হবে।

★প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য নির্ধারিত বই থাকতে হবে যাতে শিক্ষক ও অভিভাবকের সমন্বয়ে শিশুদের শেখানো যায়।
★প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা,গনিত, ইংরেজির পাশাপাশি আরবিসহ মোট চারটি বই থাকতে হবে।যাতে নৈতিকতা ছোট থেকেই শেখানো যায়।

★চতুর্থ ও ৫ম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান ও ধর্ম সহ ৬টি বই রাখতে হবে।এখানে ৬০ শতাংশ লিখিত এবং ৪০ শতাংশ এ্যাসাইনমেন্ট ভিত্তিক পরীক্ষা চালু রাখা যেতে পারে।

★৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ধর্মশিক্ষা (প্রত্যকে ধর্ম অনুযায়ী) সহ সর্বোচ্চ ৮টি বিষয় নির্ধারন করা।এখানে ও ৬০ শতাংশ লিখিত এবং ৪০ শতাংশ এ্যাসাইনমেন্ট ভিত্তিক পরীক্ষা চালু রাখা যেতে পারে।

★একাদশ ও দ্বাদশে পাঠ্যসূচির পর প্রতি বর্ষ শেষে একটি বোর্ড পরীক্ষা নিশ্চিত করা। এখানে ৫০ শতাংশ লিখিত এবং ৫০ শতাংশ এ্যাসাইনমেন্ট ভিত্তিক কিংবা কারিগরি ভিত্তিক পরীক্ষা চালু রাখা যেতে পারে।

★বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণায় দেখা যায়, পিইসি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য দেশের ৮৬ শতাংশের বেশি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে হতো। আবার ৭৮ শতাংশ সরকারি বিদ্যালয়ে এই পরীক্ষার জন্য কোচিং ছিল বাধ্যতামূলক।তাই প্রথম পাবলিক পরীক্ষা ৮ম শ্রেণীতে,অত:পর দশম শ্রেণিতে সর্বশেষে দ্বাদশে গিয়ে রাখতে হবে। এরপর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পরীক্ষার সমন্বয়ে দ্বিতীয় পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়ন হবে।

★পরীক্ষার ফলাফলে ডিভিশন , নম্বর ও গ্রেড থাকবে। তিন শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে।
★ ২০০৮ সালে দেশে সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল।যা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছিল।শিক্ষকরা এটি কার্যকরে ব্যর্থ ছিল। ৩৮ শতাংশের বেশি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করতেই পারেননি।তাই সৃজনশীল পদ্ধতি বাতিল করে লিখিত,এক কথায় প্রশ্নের উত্তর এবং বিবরন মূলক প্রশ্ন পদ্ধতি চালু রাখতে হবে।

★শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা ছাড়া শিক্ষাক্রম চালু রাখা যাবেনা। উপজেলা পর্যায়ে সর্বোচ্চ মেধাবীদেরকে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার পদে নিয়োগ দিতে হবে যাতে তারা তদারকি ভালভাবে করতে পারেন।

★দেশের সবখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ সমান নয় ,ইন্টারনেটের ধীরগতি। তাই ডিজিটালের নামে অনলাইনে নামকাওয়াস্তে সকল প্রশিক্ষণ বন্ধ করে স্বশরীরে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করতে হবে। মুখ দেখে ,যাচাই করে মাস্টার ট্রেইনার নিয়োগ দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

★ শ্রেণি কক্ষে শিক্ষককে সহ-শিক্ষার্থীর ভূমিকা নিতে হবে। শিক্ষকদের দশটা- চারটা ডিউটির পর হোম ভিজিট ও অভিভাবকদের সাথে শিক্ষকদের সপ্তাহ কিংবা মাসিক অন্তর বৈঠক করতে হবে।আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী শিক্ষক-শিক্ষার্থী প্রত্যক্ষ সংযোগের ন্যূনতম সময় বছরে ৯০০-১০০০ ঘণ্টা। অথচ আমাদের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা দিবসের সংখ্যা অনেক কম।

★শিক্ষার্থীদের ডায়রি অনুযায়ী প্রকল্পভিত্তিক কাজ ও অনুসন্ধানমূলক কাজে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাতে হবে। শিক্ষার্থীদের সবার মেধা সমান নয়।তাই স্লো লার্নার ও অ্যাডভান্সড লার্নার চিহ্নিত করে পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে।

★পাবলিক পরীক্ষায় নকল অহরহ চলছে।বিগত সরকার নকল বন্ধে ব্যর্থ।এটিকে বন্ধ করতেই হবে।★শিক্ষার্থী,অভিভাবক, শিক্ষকসহ অংশিজনের অংশগ্রহণে বছরে ৩টি অভিভাবক সমাবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
★প্রতি ৩ মাসে কমপক্ষে একবার শিক্ষকদের ইন হাউজ প্রশিক্ষণের আয়োজন করতেই হবে।
★শ্রেণিকক্ষে এবং শ্রেণিকক্ষের বাইরে অ্যাক্টিভিটি বেইসড লার্নিং কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে।

*উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে শিক্ষা বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ শিক্ষার উন্নয়নেই যাতে ব্যয় হয় তা নিশ্চিত করা ।
★দেশে মাধ্যমিকে ১৯৯২ সালে বহুনির্বাচনী প্রশ্ন (এমসিকিউ) ব্যবস্থা চালু করা হয়। এটি এখনো আছে।এটি বাদ দিতে হবে। এটির কারনে পরীক্ষার হলে শিক্ষক অসদুপায় অবলম্বন করে।

★বিদ্যমান বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্যায়নব্যবস্থা ঠিকমতো কাজ করছে না।এখানে পরীক্ষার উত্তরপত্র শিক্ষার্থীদের কিংবা গার্ডিয়ানদের দেখানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে।
★চাকুরীর বাজারে ইংরেজির আধিপত্য অপরিসীম।অথচ মাউশি পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ষষ্ঠ-৯ম শ্রেণিতে ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থীর ইংরেজিতে অবস্থা খারাপ। একই শ্রেণিতে গণিতে ৪৩ শতাংশের খারাপ বা গড়পড়তা অবস্থা। দেশে প্রথম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ইংরেজি বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হয়। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন শেষ করার পরেও ইংরেজিতে সাধারণ যোগাযোগেও ব্যর্থ। এতে চাকুরীর বাজারে তারা পরাজিত হচ্ছেন কিংবা কর্মক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ছেন।তাই ইংরেজি শিক্ষায় গুরত্ব বাড়াতে হবে।

★শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত একটি যুক্তিযুক্ত সীমার মধ্যে রাখতে হবে, যা প্রাথমিক স্তরের জন্য ১:৩৫ নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের জন্য ১:৪৫ এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ১:২৫-এর মত হয়।
★মান সম্মত শিক্ষার উপকরন নিশ্চিত করতে হবে।
মানসম্মত শিক্ষার মূল উপাদান মানসম্মত শিক্ষক, মানসম্মত শিক্ষা উপকরণ ও মানসম্মত পরিবেশ।
★সময়মত সিলেবাস শেষ করার ব্যবস্থা করা।
১৪সপ্তাহের ৪২টি ক্লাসে যদি ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের সিলেবাস শেষ করা যায় তাহলে স্কুল ও কলেজে ৫২ সপ্তাহে কেন সিলেবাস শেষ করা যাবেনা।পরিকল্পিত সিলেবাস তৈরি করতে হবে।

★স্মার্টফোনের বিনোদন জগৎ শিক্ষার্থীদের মনঃসযোগ কমায় ও পড়ালেখার মূল্যবান সময় নষ্ট করে। আমেরিকার স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ জার্সি দুই বছর ধরে দুই হাজার ৬০০ স্কুলছাত্রের ওপর একটি গবেষণা সমীক্ষা চালায়। গবেষণায় দেখা গেছে, স্মার্টফোন বা ডিভাইসে যারা দীর্ঘ সময় কাটায় তাদের মনোযোগের মারাত্মক ঘাটতি দেখা দেয়। যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ADHD (Attention Deficit Hyperactivity Disorder) বলে। তাই মাগরিব থেকে ফজর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।প্রয়োজনে এ ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোকে ফলো করা যেতে পারে।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো বৈষম্যে ভরপুর।

বৈষম্যহীন সমন্বিত শিক্ষা, আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাক্রম ও মানসম্মত শিক্ষক পেতে শিক্ষায় অধিক বিনিয়োগ প্রয়োজন।সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে সামগ্রিক শিক্ষক ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মাত্র ০.৯২ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষা উপ-খাতে বরাদ্দ মাত্র ০.১২ শতাংশ, যা সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। উল্লেখ্য, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, ভারত ও নেপালে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মোট জিডিপির তুলনায় যথাক্রমে ৪.৫ ও ৩.৫ শতাংশ।
বর্তমানে যে পরিমাণ অর্থ

শিক্ষক ও শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়, তা অপ্রতুল। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বার্ষিক বিনিয়োগের পরিমাণ বাংলাদেশে ৫ ডলার, শ্রীলংকায় ১০ ডলার, ভারতে ১৪ ডলার, মালয়েশিয়াতে ১৫০ ডলার ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬০ ডলার।ইউনেস্কো নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির অন্ততপক্ষে ছয় শতাংশ ও মোট বাজেটের ২৫ শতাংশ হওয়া উচিত। শিক্ষায় জিডিপির ১.৯ শতাংশ বরাদ্দ নিয়ে বিশ্ব উন্নয়ন সূচকের হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৬১টি দেশের মধ্যে ১৫৫তম।

তাই শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো সময়ের দাবী।মনে রাখতে হবে শিক্ষকদের সন্মানজনক আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া উপরের কোন সংস্কার ই বাস্তবায়িত হবেনা।

লেখকঃ বিভাগীয় প্রধান(অনার্স. এম. এ শাখা)আয়েশা ( রা:) মহিলা কামিল (অনার্স,এম. এ) মাদরাসা,সদর,লক্ষীপুর ও
সদস্য সচিব, বাংলাদেশ মাদরাসা জেনারেল টিচার্স এসোসিয়েশন(বিএমজিটিএ)।

সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ