দাবি আদায় করতে গিয়ে সচিবালয় ঘেরাও এবং পরে ছাত্র-জনতার সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে এখন আলোচনায় আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। এরই মধ্যে আনসার বাহিনীকে বিলুপ্তের দাবিসহ তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনাও শুরু হয়েছে। আনসারের মারমুখী আচরণের কারণে প্রশ্ন উঠেছে, এই আন্দোলনের নেপথ্যে পতিত আওয়ামী লীগের কোনো ইন্ধন রয়েছে কি না?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত রোববার আনসার বাহিনীর সদস্যরা যে ধরনের আচরণ করেছেন, এর দায় পুরো বাহিনীর নয়। যারা আন্দোলন করছেন, তারা পুরো বাহিনীরও প্রতিনিধিত্বও করেন না। আন্দোলনকারীরা আনসার বাহিনীর অস্থায়ী সদস্য, যারা বাহিনীতে ‘অঙ্গীভূত আনসার’ হিসেবে পরিচিত। গত রোববার আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, বিশৃঙ্খল আন্দোলনকারীরা অঙ্গীভূত আনসার, যাদের সঙ্গে ব্যাটালিয়ন আনসারের কোনো সম্পর্ক নেই। এ ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকার অনুরোধ জানাই।
আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর নানা স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাহিনীতে এই অঙ্গীভূত আনসার সদস্য রয়েছে অন্তত ৭০ হাজার, যারা সবাই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। তবে প্রতি তিন বছর দায়িত্ব পালনের পর ৬ মাস করে তাদের ছুটিতে পাঠানো হয়। প্রয়োজনে তাদের আবার ডেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মূলত তারা স্থায়ীভাবে নিয়োগ বা চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে কর্মবিরতিসহ নানা আন্দোলন করে আসছিলেন।
কয়েকদিন ধরে অঙ্গীভূত এই আনসার সদস্যদের বড় একটা অংশ বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ স্থানে কর্মবিরতি পালন করে আসছিলেন। তাদের অনেক দাবি যৌক্তিক বিবেচনায় তা যাচাই করে বাস্তবায়নের জন্য কমিটিও করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। এরপর তাদের কর্মে যোগ দিতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু গত রোববার কয়েক হাজার অঙ্গীভূত সদস্য প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের প্রতিটি ফটক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। দিনভর তাদের এই বিক্ষোভের কারণে কার্যত অচল হয়ে পড়ে সচিবালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম। অফিস সময় শেষ হলেও ভেতরে আটকা পড়েন উপদেষ্টাসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের দাবি আদায়ের আশ্বাস দেওয়া হলেও তারা অবরোধ না তুলে বরং মারমুখী হয়ে ওঠেন। এরপর রাত সাড়ে ৮টার দিকে ছাত্র-জনতা অবরোধকারী আনসার সদস্যদের সরিয়ে দিতে গেলে হামলা চালান আনসার সদস্যরা। এতে অর্ধশতাধিক ছাত্র আহত হন।
আনসার বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোববার আন্দোলনকারী আনসার সদস্যদের নিরস্ত্রীকরণ করার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সচিবালয়ে নাশকতার অভিযোগে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একাধিক মামলাও হয়েছে। ধীরে ধীরে সবাইকে নিরস্ত্রীকরণ করা হবে। আনসার বাহিনীর দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, অঙ্গীভূত আনসার সদস্যদের মধ্যে রোববার পর্যন্ত ৫৫ হাজার সদস্য দায়িত্ব পালন করছিলেন। ১৫ হাজার সদস্য বিশ্রামে ছিলেন। এখন যারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন বা যারা আন্দোলনের নামে নাশকতা করেছে তাদের বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাদের স্থলে বিশ্রামে থাকা সদস্যদের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
অঙ্গীভূত আনসারের কাজ কী: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অঙ্গীভূত আনসার সদস্যরা মূলত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ‘বৈধ ভাড়াটে কর্মী’ হিসেবে নিরাপত্তা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। অর্থাৎ কোনো প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্বে আনসার সদস্য প্রয়োজন হলে বাহিনীতে আবেদন করলে তাদের সেই দায়িত্বে পাঠানো হয়। সেক্ষেত্রে বাহিনীর অনুকূলে চুক্তি অনুযায়ী এই দায়িত্ব পালনের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অর্থ পরিশোধ করে থাকে। তবে বাহিনী থেকে বেতন হয় এই সদস্যদের।
অঙ্গীভূত আনসার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা মোট ১৬ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে চাকরি করেন। এ ছাড়া তাদের প্রতি মাসে রেশন হিসেবে ২৮ কেজি চাল, ২৮ কেজি গম, দুই কেজি ডাল, দুই কেজি চিনি ও দুই লিটার ভোজ্যতেল দেওয়া হয়। এই রেশন তুলতে তাদের কাছ থেকে ৫৯৮ টাকা জমা রাখা হয়। তবে ৬ মাসের বিশ্রামে গেলে তাদের কোনো বেতন বা রেশন দেওয়া হয় না। অঙ্গীভূত আনসারে যোগ দিতে বাহিনী থেকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এতে ন্যূনতম এসএসসি পাস প্রার্থী চাওয়া হলেও মাস্টার্স পাস প্রার্থীরাও আবেদন করে থাকেন।
আনসার বাহিনীর সূত্র জানায়, এই অঙ্গীভূত আনসার সদস্যরা সারা দেশে ৫ হাজার ৭০১টি সংস্থায় দায়িত্ব পালন করছিলেন। এর মধ্যে বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, শিল্পকারখানা, বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ব্যাংক, গ্যাস ও বিদ্যুৎকেন্দ্র, শপিংমল, গার্মেন্টস শিল্প, লঞ্চ ও সমুদ্রবন্দর, ট্রাফিক ও ইপিজেড রয়েছে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনাতেও দায়িত্ব পালন করছেন এই আনসার সদস্যরা।
ব্যাটালিয়ন আনসার কারা: মূলত আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্যরা স্থায়ী সদস্য। সরকারি বিধি অনুযায়ী তাদের নিয়োগ ও বেতন-ভাতা হয়। বাহিনীতে বতর্মানে কয়েকটি ব্যাটালিয়নে নারী-পুরুষ মিলে ১৫ হাজারের বেশি সদস্য রয়েছে।
আনসার বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এই ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্যরা জাতীয় সংসদ ভবনে প্রবেশ গেট, ঢাকা ফাস্ট এলিভেডেট এক্সপ্রেসওয়ে, প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর, রামপুরা টিভি ভবন, রাষ্ট্রীয় তোষাখানা, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কক্সবাজার ও ভাষাণচরে শরণার্থী ক্যাম্প, রামু বৌদ্ধমন্দির, মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প এলাকা, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, মাতারবাড়ী তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ-কেন্দ্রসহ ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
আনসার গার্ড ব্যাটালিয়ন বা এজিবি: আনসার বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এজিবি মূলত আনসার বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষায়িত ইউনিট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। এই ইউনিটের সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও স্থাপনার নিরাপত্তা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বাহিনী সূত্র জানায়, বর্তমানে এজিবি সদস্যরা ঢাকায় ফিলিস্তিন দূতাবাস, মার্কিন দূতাবাস, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন, আইসিডিডিআর’বিতে বিদেশি ব্যক্তিদের নিরাপত্তা দেওয়া ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাহিনীর মহাপরিচালকের নির্দেশে আনসার গার্ড ব্যাটালিয়নের সদস্যরা বিভিন্ন আভিযানিক ও দুর্যোগ মোকাবিলায় দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
ভিডিপি (গ্রাম প্রতিরক্ষা দল) সদস্য যারা: আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে দেশের প্রত্যেক গ্রামেই ভিডিপি বা গ্রাম প্রতিরক্ষা দল রয়েছে। মূলত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষদের নানা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মমুখী করা হয় বাহিনীর পক্ষ থেকে। বাহিনীতে এ ধরনের সদস্য রয়েছে ৬২ লাখের বেশি। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনকেন্দ্রে এবং দুর্গাপূজাসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে এই ভিডিপি সদস্যরা দায়িত্ব পালন করে থাকেন।