গাজীপুরে মাহমুদ জিনস ও মাহমুদ ডেনিম লিমিটেড নামে বন্ধ হওয়া একটি পোশাক কারখানার মালিক তার গুলশানের বাড়িটি বিক্রির প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করলেও পেমেন্ট না পাওয়ার কারণে শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন। এতে এতে শ্রমিকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে কারখানার সামনেই বিক্ষোভ শুরু করেন।
পরে তারা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ডেকে নিয়ে গেলে কারখানার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক রাফি মাহমুদকে (ডিএমডি) শ্রমিকরা মারধর করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ ঘটনায় শুক্রবার (২৯ নভেম্বর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। এর আগে বৃহস্পতিবার বিকেলে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। শ্রমিকদের মারধরে আহত রাফি মাহমুদ কালিয়াকৈর উপজেলার মাহমুদ জিনস ও মাহমুদ ডেনিম লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচলক।
বেতনের দাবিতে মাহামুদ জিনস লিমিটেড নামের ওই কারখানার শ্রমিকেরা আজও (শুক্রবার) কারখানার সামনে জড়ো হয়ে মহাসড়ক অবরোধ করার চেষ্টা করেন। সকাল ১০টার দিকে শ্রমিকেরা বিক্ষোভের চেষ্টা করলে শিল্প পুলিশ শ্রমিকদের সরিয়ে দেয়।
শিল্প পুলিশ, শ্রমিক ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চন্দ্রা মোড় এলাকায় অবস্থিত মাহামুদ জিনস লিমিটেডে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। বিভিন্ন সংকটের জন্য গত ৯ অক্টোবর কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করেছে মালিকপক্ষ।
পাশাপাশি কারখানা কর্তৃপক্ষ, শ্রমিক, বিজিএমইএ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করে ২৮ নভেম্বর শ্রমিকদের বেতনসহ অন্যান্য পাওনা পরিশোধের কথা বলা হয়। সেই অনুযায়ী বৃহস্পতিবার সকালে কারখানাটির সামনে আসতে থাকেন শ্রমিকেরা। কিন্তু এর মধ্যেই পাওনা পরিশোধ করা হবে না জানিয়ে নোটিশ টাঙিয়ে দেয় কারখানা কর্তৃপক্ষ। এতে শ্রমিকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে কারখানার সামনেই বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে তারা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করে।
গাজীপুর শিল্প পুলিশ জানায়, শ্রমিক আন্দোলনের খবর পেয়ে বিকেল চারটার দিকে মালিকপক্ষ কারখানাটির সামনে এসে শ্রমিকদের সঙ্গে বকেয়া বেতনের বিষয়ে কথা বলেন। এ সময় উত্তেজিত শ্রমিকেরা মালিকপক্ষের লোকজন ও শিল্প পুলিশের সদস্যদের ওপর ইটপাটকে নিক্ষেপ করেন। তখন শিল্প পুলিশ, থানা-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে সরে যান।
পরে শ্রমিকেরা মালিকপক্ষের লোকজনকে কারখানাটির ভেতরে অবরুদ্ধ করেন। তখন কারখানার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক রাফি মাহমুদ উত্তেজিত শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে নিজেই তাদের সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে যান। একপর্যায়ে শ্রমিকেরা তার ওপর হামলা চালান। শ্রমিকদের পিটুনিতে তিনি গুরুতর আহত হন। তখন শ্রমিকদের একটি অংশ তাকে উদ্ধার করে।
বিষয়টির বর্ণনা দিয়ে কারখানার মানবসম্পদ (এইচআর) বিভাগের প্রধান অহিদুল ইসলাম বলেন, বৃহস্পতিবার স্যার (রাফি মাহমুদ) শ্রমিকদের বলছিলেন, আমার কাছে এই মুহূর্তে টাকা নেই। আমি আপাতত টাকা দিতে পারছি না। তোমরা আমাকে আরেকটু সময় দাও। কিন্তু শ্রমিকেরা বলছিলেন, টাকা আজকের মধ্যেই দিতে হবে। তখন স্যার বলছিলেন, টাকা না দিতে পারলে তোমরা কি আমারে মারবা, ঠিক আছে মারলে মারো। এই রকম কথা বলার পর শ্রমিকেরা স্যারকে ফিজিক্যাল অ্যাসল্ট করেছে।
শ্রমিকেরা আন্দোলন করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তার ছেলেকে ফোনে ডেকে সেখানে নিয়ে যান জানিয়ে রাফি মাহমুদের বাবা কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম আমিনুল ইসলাম বলেন, ওই কারখানায় প্রায় চার হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। বৃহস্পতিবার তাদের টাকাপয়সা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু টাকা ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। । রাফি মাহমুদ রাত আটটা পর্যন্ত কারখানার ভেতরে অচেতন অবস্থায় পড়েছিলেন। তাকে চিকিৎসা পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান।
এ ব্যাপারে গাজীপুর শিল্প পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার আবু তালেব বলেন, কারখানার শ্রমিকেরা আন্দোলন করলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের বলা হয়েছে, শ্রমিকদের সমস্যা সমাধান করেন। তখন উনি (রাফি মাহমুদ) কারখানায় এসে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে শ্রমিকেরা উত্তেজিত হয়ে তাকে মারধর করেন। পরে আমরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকায় হাসপাতালে পাঠিয়েছি।
এদিকে, হামলার ঘটনায় নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়ে বিজিএমইএ জানিয়েছে, কারখানার মালিকের ছেলে মো. রাফি মাহমুদ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় শ্রমিক নামধারী কিছু উসকানিদাতা, দুষ্কৃতকারী হঠাৎ করে তার ওপর আক্রমণ করেন এবং আহত করে কারখানায় নিয়ে আটকে রাখেন। আলোচনার মধ্যে এ রকম হামলা অনভিপ্রেত।
শুক্রবার বিজিএমইএর মহাসচিব মো. ফয়জুর রহমান স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিজিএমইএ মনে করে, এ ধরনের ঔদ্ধত্য সব শিল্পের ওপর আঘাত। যে শিল্প দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি, যে শিল্প প্রত্যক্ষভাবে ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে, যে শিল্প পরোক্ষভাকে দেশের ৫ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার সুরাহা করেছে, তার ওপর এ আঘাত মোটেও কাম্য নয়। এ ঘটনা বহির্বিশ্বে এ দেশের শিল্প সম্পর্কে ভুল বার্তা দেবে। যারা উসকানি দিয়ে শিল্পকে অস্থিতিশীল করার অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে, শিল্প ও অর্থনীতিকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বিজিএমইএ।
মাহমদু জিনস লিমিটেড কারখানার বিষয়ে বিজিএমইএর বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নানা কারণে নানা পরিস্থিতেতে একটি ভালো মানের কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হয়। গত ৯ অক্টোবর শ্রম ভবনে অনুষ্ঠিত কলকারখানা অধিদপ্তরের নেতৃত্বে ত্রিপক্ষীয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২৩ অক্টোবর কারখানার শ্রমিকদের সেপ্টেম্বর মাসের মজুরি বাবদ ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়।
১৬ নভেম্বর স্টাফদের বকেয়া মজুরি থেকে ২ কোটি টাকাও পরিশোধ করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী শ্রমিক ও স্টাফদের চূড়ান্ত পাওনা, সার্ভিস বেনিফিট, ছুটির টাকা বাবদ প্রায় ২০ কোটি টাকা ২৮ নভেম্বর পরিশোধ করার কথা ছিল। এই টাকা পরিশোধ করার জন্য কারখানার মালিক তার গুলশানের বাড়িটি বিক্রির প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করলেও পেমেন্ট না পাওয়ার কারণে ২৮ নভেম্বরে শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন।
সূত্র: প্রথম আলো