৯ মাস ধরে ৬ প্রকল্পে অর্থছাড় বন্ধ রেখেছে চীনের এক্সিম ব্যাংক, চলমান ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তা চায় দেশটি। অর্থছাড় না করায় প্রকল্পগুলোয় যদি ব্যয় বাড়ে, সেই দায় চীনের নেওয়া দরকার মনে করেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী শফিকুল আজম।
ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ চলমান বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় আছে চীন। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দেখা দিয়েছে একরকম স্থবিরতা। শেষ সময়ে এসে মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এর দায় নেবে কে? এমন প্রশ্নও উঠেছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রকল্প ঘুরে দেখেছে চীনের এক্সিম ব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) আশা করছে, শিগ্গিরই এ অচলাবস্থা কেটে যাবে। আর পুরোনো একটি প্রকল্প কার্যকর করতে নতুন করে আরেকটি প্রকল্পে অর্থায়নের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে চীনের কাছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইআরডির সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী শফিকুল আজম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, আলাদা করে ঋণ পরিশোধের গ্যারান্টি দেওয়ার তো কিছু নেই। যখন ঋণচুক্তি হয়েছিল, তখন সরকারের সভরেন গ্যারান্টি দিয়েছে। সেক্ষেত্রে যে কোনো বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে সরকার বাধ্য।
যেমন সাংবিধানিকভাবেই প্রতিবছর বাজেটে কিছু চার্জ এক্সপেনডিচার (যেসব খরচ দিতেই হবে) রাখা হয়। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, সুদ এবং সরকারি মামলা-মোকদ্দমার ব্যয় যুক্ত থাকে। এছাড়া অতীতে বাংলাদেশ কখনো ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়নি। তাহলে চীনের এমন আশঙ্কা অমূলক।
এরপরও যখন বিষয়টি সামনে এসেছে, তখন ইআরডির উচিত সঠিক নেগোশিয়েশন (আলোচনা) করা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নয় মাস অর্থছাড় না করায় প্রকল্পগুলোয় যদি ব্যয় বাড়ে, সেই দায় চীনের নেওয়া দরকার। পাশাপাশি সঠিক সময় বাস্তবায়ন না হওয়ায় এর একটা ‘টাইম কস্ট’ বা সময় নষ্ট হচ্ছে। যে সময় যে সুফল পাওয়ার কথা, সেটা মিলবে না।
সূত্র জানায়, ফেব্রুয়ারি থেকে চীন যেসব প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ রেখেছে, সেগুলো হলো-পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প, ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন, পাওয়ার সিস্টেম স্ট্রেংদেনিং ফর ডিপিডিসি প্রজেক্ট, পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক স্ট্রেংদেনিং ফর পিজিসিবি প্রজেক্ট, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ এবং রাজশাহী ওয়াসার ভূ-উপরিস্থ পানি শোধনাগার প্রকল্প।
এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে চীনের এক্সিম ব্যাংকের। এগুলোর বাস্তবায়ন এগিয়েছে অনেক দূর। এমনকি কোনোটির অগ্রগতি ৯০ শতাংশের ওপরে। কিন্তু চীন অর্থছাড় না করায় বেশ বিপাকে পড়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। উল্লেখ্য, চীনা ঋণে চারটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে।
এগুলো হলো-কর্ণফুলী টানেল, দাশেরকান্দি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, ইনফো সরকার-৩ (তৃতীয় পর্যায়) এবং মর্ডানাইজেশন অব টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক প্রজেক্ট।
ইআরডি সূত্র জানায়, বর্তমান টানাপোড়েনের অবসান ঘটানো কার্যক্রমের অংশ হিসাবে ২২ থেকে ২৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সফর করেছে চীনা এক্সিম ব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল। দুই সদস্যের এ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন চীনা এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক জাহাং উন।
বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন ইআরডি অতিরিক্ত সচিব ও এশিয়া উইং প্রধান মিরানা মাহরুখ। প্রতিনিধিদলটি চলমান তিনটি প্রকল্পের কার্যক্রম সরেজমিন পরিদর্শন করে। এগুলো হলো-পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক স্ট্রেংদেনিং ফর পিজিসিবি প্রজেক্ট এবং দাশেরকান্দি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। এ সময় প্রকল্পসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তিনদিনের মধ্যে প্রতিনিধিদলটি ইআরডি সম্মেলন কক্ষে বৈঠক করার পাশাপাশি প্রকল্পস্থলেও একাধিক বৈঠক করেছে।
এ প্রসঙ্গে ইআরডির দায়িত্বশীল একটি সূত্র যুগান্তরকে জানায়, চীন ফেব্রুয়ারি থেকে অর্থছাড় বন্ধ রেখেছে। তারা বলেছে, (চীনা এক্সিম ব্যাংক) ডলার সংকটের কারণে আমরা ঋণ পরিশোধ করতে পারব কি না। আমরা তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, বাংলাদেশ কখনো বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কোনো কিস্তি মিস করেনি। প্রকল্পের অগ্রগতি দেখেও তারা বেশ খুশি হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, শিগ্গিরই চলমান ৬ প্রকল্পে অর্থছাড় শুরু হবে।
পাশাপাশি প্রস্তাবিত নতুন প্রকল্পের বিষয়েও সিদ্ধান্ত জানাবে চীন। এ সফরে তেমনই ইঙ্গিত মিলেছে। তবে কোন মাস থেকে অর্থছাড় শুরু হবে, সেটি এখনো স্পষ্ট করে বলেনি তারা। তবে রাজশাহী ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী ও ভূ-উপরিস্থ পানি শোধনাগার প্রকল্পের পরিচালক মো. পারভেজ মামুদ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, আমার প্রকল্পে পুরোপুরি অর্থছাড় বন্ধ বলা যায় না। তবে কিছু বিল দাখিল করার পর সেগুলো এখনো দেয়নি। বিলগুলোর বিষয়ে বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছে চীন। আমরা সেগুলো সংশোধনের কাজ করছি।
সূত্র জানায়, দাশেরকান্দি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টকে পুরোপুরি কার্যকর করতে নেটওয়ার্ক সিস্টেম অব দাশেরকান্দি এসটিপি (সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) শীর্ষক একটি নতুন প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে চীনের কাছে। এটি বাস্তবায়িত হলে গুলশান, বনানী, রামপুরাসহ ঢাকা বিভিন্ন এলাকার মনুষ্য বর্জ্য পরিশোধন করা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার একটি সূত্র জানায়, ঢাকা শহরের জন্য ২০১২ সালের পয়ঃনিষ্কাশন মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়। কিন্তু সেটির বাস্তবায়ন হয়নি।
বর্তমানে রাজধানীর মাত্র ২০ শতাংশ পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থার মাধ্যমে পরিশোধন করা হচ্ছে। মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ঢাকা শহরকে ৫টি ক্যাচমেন্টে ভাগ করে ৫টি পয়ঃনিষ্কাশন শোধনাগার (এসটিপি) নির্মাণ করা প্রয়োজন। নির্ধারিত এ ৫টি অঞ্চল হলো মিরপুর, রায়েরবাজার, উত্তরা, পাগলা ও দাশেরকান্দি। এগুলোর মধ্যে দাশেরকান্দি সুয়ারেজ প্ল্যান্টটি হচ্ছে প্রথম পয়ঃশোধনাগার।
সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঢাকা সফরে আসেন। এ সময় ২৭টি প্রকল্পের বিপরীতে ২১ বিলিয়ন ডলার ঋণেল বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়। সেখান থেকেই যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। চীনা এক্সিম ব্যাংক বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত ছাড় করেছে ৫০০ কোটি ডলারের মতো। বাংলাদেশ বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতাদের মধ্যে যে পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ আছে, এর ৯ শতাংশ হচ্ছে চীনের ঋণ। সবচেয়ে বেশি বিশ্বব্যাংকের ৩১ শতাংশ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ২৩ শতাংশ, জাপান ১৭ শতাংশ, রাশিয়া ১০ শতাংশ এবং ভারত ২ শতাংশ।