দেশে কোনো ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে আন্দোলন শুরু হলেই অবধারিতভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জসিমউদ্দিন মানিকের নাম আলোচনায় উঠে আসে।
মানিকের শেষ পরিণতি সম্পর্কেও নতুন নতুন গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়। কখনো শোনা যায় মানিক ইতালিতে মারা গেছেন। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, তিনি দেশে ফিরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি করছেন। দাঁড়ি রেখে সুরতে বদল এনেছে।
জাবির প্রভাবশালী শিক্ষক অধ্যাপক আফসার আহমেদ ও ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বর্তমান প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক শামীমের আত্মীয় হিসাবে দুর্দান্ত প্রতাপের সঙ্গে ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করতো মানিক।
সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরও সেই ছিল একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিপতি। ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে যায় মানিক। ফলাফল, তীব্র আন্দোলনের মুখে ক্যাম্পাস থেকে পিছু হটে যায় দলবল নিয়ে।
এরপর ঘনিষ্টজন ছাড়া আর কেউ মানিককে প্রকাশ্যে দেখেনি। তাকে নিয়ে নানা গাল গল্প ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ মানিক ধর্ষণ করেনি বলে ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করছে। অনেকেই ইনিয়ে বিনিয়ে প্রশ্ন করে, মানিক কি আসলেই ধর্ষণ করেছিল?
মানিকের লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যাওয়া ও নানাবিধ কথাবার্তার কারণে স্বপ্রণোদীত হয়ে জাবির সাবেক শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে “মানিক অনুসন্ধান কমিটি” গঠন করা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্নভাবে অনুসন্ধান কমিটি মানিকের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছে।
ইতালিতে চলে যায় মানিক
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার হওয়ার পর কোনো এক সময় মানিক ইতালিতে চলে যায়। মানিক সম্পর্কে সব থেকে প্রচলিত তথ্য হচ্ছে মানিক ইতালিতে মারা গিয়েছে। এই তথ্য ধরেই কমিটি অনুসন্ধান শুরু করে। ইতালির বিভিন্ন শহরে বাঙালি কমিউনিটিতে মানিকের ছবি সরবরাহ করে অনুসন্ধান শুরু হয়।
যদিও প্রাথমিকভাবে তথ্য ছিল মানিক ইতালির পাদোভা শহরে বসবাস করতো স্ত্রী সন্তান নিয়ে। পাদোভাতেও বিভিন্ন জনের নিকট মানিকের ছবি পাঠানো হয়। অনুসন্ধান কমিটি সরেজমিনে পাদোভা শহরে গিয়ে কাজ করতে চাইলেও করোনা প্রার্দুভাবের কারণে তা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহের জন্য ভিডিও কল বা অডিও কল করে বিভিন্ন জনের সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়।
আরও পড়ুনঃ শাবিপ্রবির উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষকে শপথপাঠ, সমন্বয়কদের দুঃখ প্রকাশ
অনুসন্ধান কমিটির সদস্যরা পাদোভা শহরের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে। সবাই ছবি দেখে জানিয়েছেন মানিককে তারা চিনতেন। পরিচিত ছিলেন। মানিক পাদোভা শহরেই বসবাস করত। সেখানে একটি কারখানায় চাকুরি করে জীবিকা নির্বাহ করত মানিক।
তবে বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে তেমন বেশি মেলামেশা করতেন না। তবে সেখান বাঙালি কমিউনিটি একটি মসজিদ গঠনের উদ্যোগ নিলে মানিক তাতে শরিক হন। মসজিদের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করে দেন। তবে মানিক কবে নাগাদ ইতালি প্রবেশ করে এটা নিশ্চিত বলতে পারেনি কেউ। সাক্ষাতকার দাতাদের অনেকই জানিয়েছেন, নিজের পরিচয় গোপন রাখতেই মানিক রোম বা মিলানের মত বড় শহরে না গিয়ে অপেক্ষাকৃত অপরিচিত শহর পাদোভাতে যান।
মানিককে নিয়ে বাঙালি কমিউনিটিতে প্রশ্ন
পাদোভার বাঙালিরা জানতেন মানিক দেশে ছাত্রলীগের বড় নেতা ছিলেন। কিন্তু পাদোভা বা ইতালিতে রাজনীতি বা সামাজিক অনুষ্ঠানে খুব বেশি আসতেন না। স্বাভাবতই অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছিল এত বড় নেতা হয়ে তিনি প্রকাশ্যে খুব বেশি আসেন না কেন? মানিকের ধর্ষনের ঘটনা নিয়েও বাঙালিদের মধ্যে কানাঘুষা ছিল। অনেকেই মনে করতেন এই মানিকই সেই সেঞ্চুরিয়ান মানিক। তবে তাদের কাছে নিশ্চিত তথ্য ছিল না। এক ধরনের ধোয়াশার মধ্যে ছিল অনেকেই।
হঠাৎ করে মৃত্যু হয় মানিকের
২০১০ সালে হঠাং করেই মৃত্যু হয়ে মানিকের। একদিন সন্ধ্যায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায় মানিক। বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তথ্য পেয়ে প্রতিবেশি মো. সেলিম দ্রুত মানিকের বাসায় আসেন। এসে তিনি দেখতে পান মানিককে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে। পরে হাসপাতালে নিলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ছবি দেখে মানিককে শনাক্ত করেছেন মো. সেলিম।
ওই সময়কার বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের সভাপতি সেলিম অনুসন্ধান কমিটিকে জানান, মানিকের সঙ্গে আমার পাদোভাতেই পরিচয় হয়। অসুস্থ হওয়ার তথ্য পেয়ে আমরা কয়েকজন তারা বাসায় এসেছিলাম। আমিই সবার আগে তার বাসায় পৌঁছাই। পরে হাসপাতালে মৃত্যু নিশ্চিত হলে পাদোভোতেই মৃতদেহ গোসল করিয়ে কফিনবন্দী করে দেশে পাঠানো হয়।
এর আগে স্থানীয় বাংলাদেশি মসজিদে তার জানাজা পড়ানো হয়। মৃতদেহ দেশে পাঠানোর জন্য বিভিন্ন জনের কাছ থেকে চাঁদাও সংগ্রহ করা হয়। মো. সেলিম ছাড়াও একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে একই তথ্য পেয়েছে অনুসন্ধান কমিটি।
মানিক কি আসলেই মারা গেছেন?
মানিককে নিয়ে যেহেতু নানা ধরনের কথা প্রচলিত আছে তাই অনুসন্ধান কমিটি নানা ভাবে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই করার চেষ্টা করেছে। পাদোভা সিটি কর্তৃপক্ষ বা হাসপাতাল থেকে মৃত্যু সনদ সংগ্রহেরও চেষ্টা করা হয়। তবে ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার কারণে মানিকের মৃত্যুসনদ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
মো. সেলিম বর্তমানে পাদোভা সিটি কর্তৃপক্ষের কাউন্সিলর হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি অনুসন্ধান কমিটিকে জানিয়েছেন, রোমের বাংলাদেশ দূতাবাসে মানিকের মৃত্যু সনদ সংরক্ষিত আছে। মৃতদেহ দেশে পাঠানোর সময় এই সনদ জমা দেওয়া হয়েছিল।
অনুসন্ধান কমিটির মন্তব্য
প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে প্রতীয়মান হয় যে জসিম উদ্দিন মানিক মৃত্যুবরণ করেছেন। এরপরও বিষয়টি আরো অধিকতর অনুসন্ধানের জন্য করোনার প্রভাব কমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সরেজমিনে পদোভা পরিদর্শন করা হবে। এছাড়াও অনুসন্ধানের দ্বিতীয় পর্বে গ্রামের বাড়ী শরিয়তপুরে মানিকের কবর চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হবে।
নোট: কৌশলগত কারণে অনুসন্ধান কমিটির সদস্য ও অধিকাংশ সাক্ষাতকার দাতার নাম প্রকাশ করতে অনুসন্ধান কমিটি রাজি হয়নি। (ড. মারুফ মল্লিকের লেখাটি তার ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেয়া)
কে এই সেঞ্চুরি মানিক?
জসিমউদদীন মানিক ওরফে সেঞ্চুরি মানিক। ১৯৯৮ সালে জাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। সে সময় সারাদেশে এক আলোচিত চরিত্রের নাম ছিল এটি। বলা হয়ে থাকে তিনি সেসময় দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে ক্যাম্পাসে ১০০-এর অধিক নারীকে ধর্ষণ করে তা উদযাপন করেছিলেন। এ জন্য তার নাম হয়েছিল ‘সেঞ্চুরি মানিক’।
যদিও আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে গঠিত নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি সংখ্যাটা আরো কম বলে দেখতে পেয়েছিল। সেসময়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সারা দেশের সামনে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলো, ক্যাম্পাস করেছিলো ‘মানিক গ্রুপ’ তথা ধর্ষক মুক্ত!