দেশে গত দুই মাসে ৩৫ জনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক দিনে দেশের সর্বোচ্চ দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে।
পুলিশের ভাষ্য মতে, সামাজি গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে চলেছে। তুচ্ছ কারণে মানুষ সংঘর্ষে জড়িয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে।
তবে এভাবে কেন মানুষ বারবার আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল এই হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব এসব অপকর্ম নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তা না হলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।
গতকাল বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। যারা এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গণপিটুনিতে সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। তারা এ ঘটনায় জড়িতদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, মানুষ আগের চেয়ে এখন আরো সহিংস হয়ে উঠেছে। পুলিশকেও ছাড়ছে না তারা। সড়কে ছোট ছোট বিরোধে প্রায়ই সংঘর্ষের অভিযোগ পাচ্ছে তারা। মাঠে পুলিশ এখনো স্বাভাবিকভাকে কাজ করতে পারছে না। এই সুযোগে যে যার মতো আইন হাতে তুলে নিচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে যে সহিংসতা শুরু হয়েছিল তা এখনো চলছে। এখনো মানুষের মধ্যে সহনশীলতা ফিরে আসেনি। সুযোগ পেলেই মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। চলতি বছর ১৫ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ৩৩ জনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে। মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ায় জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামের এক যুবককে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। তোফাজ্জলের মামাতো বোন বলেন, ‘তোফাজ্জল মানসিক রোগী ছিলেন। তাঁর হত্যার বিচার চাই।’
এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্ত কমিটি করে ঘটনার তদন্ত করছে। পুলিশ ঢাবি ক্যাম্পাস থেকে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে আটক করেছে।
এর আগে গত বুধবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
শুধু এ দুজনই নন, এভাবে সাম্প্রতিক সময়ে গণপিটুনিতে হত্যা বেড়েই চলেছে। এর আগে গত শনিবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সদ্যোজাত সন্তান ও স্ত্রীর জন্য ওষুধ আনতে গিয়ে রাবির মেডিক্যাল সেন্টারের একটি স্টোরে হামলার শিকার হয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া গত ৫ সেপ্টেম্বর বগুড়ায় মিজানুর রহমান মিজান নামের স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন নেতাকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন লেদু নামের একজনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে গত ১৭ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রাহাত হাসান বিপুসহ তিনজনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। অন্য দুজন হলেন সাইদুল ইসলাম ইয়াসিন (১৯) ও সাঈদ আরাফাত শরীফ (২০)।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরে গরুচোর সন্দেহে দুজনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। এভাবে এর আগেও গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে অনেকে।
শুধু হত্যাই নয়, তুচ্ছ কারণে মানুষকে ধরে গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে। গত ৮ সেপ্টেম্বর ইউটিউবার আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমকে বগুড়ার আদালত প্রাঙ্গণে কিল-ঘুষি মারার পর কান ধরে উঠবস করানো হয়। গত ১০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পটিয়ায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গুলি করে হামলার অভিযোগে করা মামলায় সাইফুল ইসলাম রনি নামের সন্দেহভাজন একজনকে গণপিটুনি দেওয়া হয়। সম্প্রতি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের দপ্তরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর উপস্থিতিতেই গণপিটুনির শিকার হন উৎসব মণ্ডল নামের এক তরুণ।
বিচারের বিষয়ে যা রয়েছে আইনে
সংবিধানের ৩১, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের আশ্রয় লাভ, আইন অনুযায়ী ব্যবহার লাভ, বিচার লাভ, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ লাভ অপরাধী-নিরপরাধী-নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী, চোর ধরা পড়লে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। আর এর ব্যতিক্রম করলে দণ্ডবিধির ১৮৭ ধারা অনুযায়ী অনূর্ধ্ব ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে। আটক রাখার পর যদি কোনো ব্যক্তিকে পিটুনি বা ধোলাই দেওয়া হয় তবে কারাদণ্ডের মেয়াদ বেড়ে দাঁড়াবে অনূর্ধ্ব তিন বছর এক মাসে। সঙ্গে অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানাও থাকছে। আঘাত করতে গিয়ে যদি গুরুতর আঘাত দেওয়া হয় তবে ৩৩৪ ধারার দণ্ডবিধি অনুযায়ী কারাদণ্ডের মেয়াদ বাড়বে আরো এক বছর। আর অর্থদণ্ড হবে অনূর্ধ্ব দুই হাজার টাকা। অবশ্য এ ক্ষেত্রে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড উভয় দণ্ডেও দণ্ডিত হতে পারে। মানুষকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত জনতার অপরাধ আদালতে প্রমাণিত হলে সবার ন্যূনতম ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’ হতে পারে।
এ বিষয়ে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার জেরে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে কঠোর বার্তা দিতে হবে। গণপিটুনির মতো অপরাধে অংশ নিলে আইনগত ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো তার নেতাকর্মীদের বহিষ্কারসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে।
মানবাধিকারকর্মী ও অপরাধ বিশ্লেষক নূর খান বলেছেন, বর্তমানে সমাজে একধরনের অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে, কিংবা অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। এখনো রাষ্ট্রব্যবস্থা পুরোপুরি পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়নি। সুতরাং এ রকম একটা সময়ে দুষ্কৃতকারীরা সুযোগ নিচ্ছে। তবে সরকারের উচিত শক্ত হাতে এসব দমন করা এবং কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।