18 C
Dhaka
Thursday, December 5, 2024

দুই বন্দর থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা লুটেন সোহায়েল

Lo

দখল, লুটপাট, নিয়মবহির্ভুত ব্যবসা, কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে ২০ হাজার কোটি টাকার মালিক নৌবাহিনী থেকে সদ্য বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল। পায়রা ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের চেয়ারম্যান থাকাকালে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সাথে যোগসাজসে অবৈধভাবে অর্জন করে এই বিপুল অর্থ।

এছাড়া র‌্যাব ও ডিজিএফআইয়ে থাকা অবস্থায় ২শ’ বিচারবর্হিভুত হত্যার অভিযোগও রয়েছে সোহায়েলের বিরুদ্ধে। হাসিনার পতনের পর গত ১৯ আগস্ট বাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলকে। এরপর ২০ আগস্ট বনানী এলাকা থেকে গ্রেফতার হন তিনি।

দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নিয়ে ডিবি নৌবাহিনীর রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ সোহায়েলকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকে সোহায়েলের নামে ২০ হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়েছে তার বিরুদ্ধে। দুদক ও গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ সব সূত্র বলছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ উপার্জনসহ সব অপকর্মই করেছেন নৌবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল। দখল, লুটপাট, বন্দরকেন্দ্রিক কমিশন বাণিজ্য, মামলার তদন্ত ধামাচাপা দেয়া এ সবই ছিল তার নেশা। বাহিনীর সুনাম-মর্যাদার কথা তিনি কখনো ভাবেননি। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দুহাতে কামিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা।

সাবেক এক সেনা কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, সোহায়েলের অপকর্মের শেষ নেই। ৫ জন মানুষের নাম উল্লেখ করে কেস দেওয়া হলে তার সঙ্গে আরও ২-৩ হাজার নাম ঢুকিয়ে দিত বাণিজ্য করার জন্য। সোহায়েলের ক্ষমতার দাপট দেশবাসী প্রথম দেখেছে যখন তিনি র‌্যাবের মুখপাত্র। পরে ডিজিএফআইয়ে যোগ দিয়ে হয়ে ওঠেন আরও ভয়ঙ্কর। ২০০ বিচারবর্হিভুত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ সোহায়েলের বিরুদ্ধে। সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও নিরীহ মানুষকে আটক করে অর্থ আদায়ের অভিযোগও বিস্তর।

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত বাধাগ্রস্তের অভিযোগ আছে সোহায়েলের বিরুদ্ধে। এসব অপকর্ম করে দ্রুতই শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কোনো জাহাজ বা ঘাঁটি কমান্ড কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কোর্স না করেই পান একের পর এক পদোন্নতি। সাথে প্রাইস পোস্টিং।
পায়রা সমুদ্র বন্দরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার পর অর্থের নেশা আরও বেড়ে যায় সোহায়েলের। অভিযোগ রয়েছে, অনিয়ম আর লুটপাটের মাধ্যমে এখান থেকেই কামিয়েছেন প্রায় হাজার কোটি টাকা।

এরপর সোহায়েলের সামনে আরও বড় সুযোগ আসে। রিয়ার এডমিরাল হয়ে ২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন তিনি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সাথে যোগসাজসে বন্দরকেন্দ্রিক সব ধরনের ব্যবসা, চুক্তি, ঠিকাদারি, নিলাম সবই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন সোহায়েল। অবৈধ কারবারিদের সহায়তায় কাস্টমসের কর্মকাণ্ডেও হস্তক্ষেপ করতেন তিনি। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অর্জন করেন হাজার বেশি টাকা।

সোহায়েলের অর্জিত বেশিরভাগ অর্থই পাচার হয়ে গেছে। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ আরও কয়েকটি দেশে রয়েছে তার সম্পদ। নিজ এলাকা ময়মনসিংহে বড় ভাই সাবেক যুগ্ম সচিব গোলাম কিবরিয়া ও আরেক ভাই শহিদের নামেও করেছেন বিস্তর সম্পদ। ব্রহ্মপুত্র পাড়ে ২শ’ একর জমি দখলে করেছেন সোহায়েলের পরিবারের সদস্যরা। যার মূল্য অন্তত ৪শ’ কোটি টাকা।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সদ্য চাকরিচ্যুত রিয়ার এডমিরাল এম সোহায়েল, এমন আরও বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় দেশ জুড়ে চলতে থাকে হত্যা-গুম-দখলদারিত্ব আর লুটপাটের রোমহর্ষক অধ্যায়। সরাসরি তাদের নেতৃত্বেই উত্থান ঘটে ব্যাংক খেকো-জমি খেকো এস আলমের।

এস আলমের পক্ষে নগ্নভাবে কাজ করে যাওয়ায় মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সামান্য নৌ-কমান্ডার থেকে এম সোহায়েলের কপালে জোটে রিয়ার এডমিরাল পদ। একই সঙ্গে বনে যান চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান। ঐতিহ্যবাহী নৌ-বাহিনীর সোহাইল-ই একমাত্র কর্মকর্তা যিনি কোন জাহাজ বা ঘাটি কমান্ড এবং গুরুত্বপূর্ণ কোন সামরিক কোর্স ছাড়াই রিয়ার এডমিরালের পদ বাগিয়ে নেন। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান হিসেবে লুটপাট করেন হাজার হাজার কোটি টাকা।

সাবেক এক সেনাকর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রামের বাঁশখালিতে সাধারণ মানুষের জমি দখল করে এস আলমের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকে কেন্দ্র করে ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল ৫ জন নিরস্ত্র গরীব খেটে খাওয়া মানুষকে হত্যার নেতৃত্বেও ছিলেন এই সোহায়েল। হত্যা-গুমসহ অসংখ্য ভয়ঙ্কর অপরাধের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। লে. কর্নেল কামরুজ্জামান (অব.) সাংবাদিকদের বলেন, আমি মনে করি যারা এই ধরনের কাজে সাথে সম্পৃক্ত থেকে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, সেই ভাবমূর্তি ফেরাতে এইসব অফিসারদের বিচার হওয়া উচিত।

আগামিতে কোন সেনা সদস্য যেন বিশেষ কোন ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত না হন, তার নিশ্চয়তা বিধানেরও দাবি জানিয়েছেন সাবেক কর্মকর্তারা। দুদকে জমা হওয়া এক অভিযোগ থেকে জানা গেছে, মোহাম্মদ সোহায়েল (পিনং ৬১৬) ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অনেক গুম ও হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের সঙ্গে মিলে এবং তার নির্দেশনায় এসব অপকর্ম করেন। এনটিএমসির সাবেক ডিজি জিয়াউল আহসান ও সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের সঙ্গে মিলে করেন বহুমাত্রিক দুর্নীতি ও অনিয়ম। সোহায়েল চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দরের চেয়ারম্যান থাকার সময় দুর্নীতির পাহাড় গড়েছেন।

যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সরকারের অপকর্মে সরাসরি জড়িত থেকে রিয়ার অ্যাডমিরাল পদোন্নতি বাগিয়ে নেন তিনি। শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশের সময় কিলিং মিশনে সরাসরি অংশ নেন সোহায়েল। বহু নিরীহ ছাত্রকে গুম করেন তিনি।
অভিযোগের তথ্য মতে, নৌবাহিনীর সাবেক এক প্রধানের সঙ্গে সখ্য থাকার সুবাদে সাবমেরিন প্রকল্প থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করেন সোহায়েল। জাহাজ ঘাঁটি কমান্ড না করে এবং এনডিসি ও এএফডব্লিউসি কোর্সে অংশ না নিয়েও রিয়ার অ্যাডমিরাল পদবি বাগিয়ে নিয়ে তারিক আহমেদ সিদ্দিকের সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অন্যায় কাজে সরাসরি অংশ নেন।

পায়রা বন্দরে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ভিতরে আনা-নেওয়া ও অবৈধভাবে পণ্য খালাসকরণের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেন। সোহায়েল সিঙ্গাপুরে ৫০০ কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অর্থপাচারের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্যে ব্যবসায় বিনিয়োগ ও বাড়ি তৈরি করেছেন। দেশে তার সম্পদের পরিমাণ শত কোটি টাকার বেশি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। রাজধানীর সাগুফতা হাউজিংয়ে নিজে ও আত্মীয়দের নামে ৭ দশমিক ৫ কাঠা প্লট কিনেছেন। উত্তরা ১৩ নং সেক্টরে ৭ তলাবিশিষ্ট বাড়ি তৈরি করেছেন।

পায়রা বন্দর সংলগ্ন এলাকায় জমি অধিগ্রহণের সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৫০ একর জমি কিনেছেন। নৌবাহিনীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সোহায়েলের মতো ধূর্ত, দুর্নীতিবাজ ও উচ্চাভিলাষী অসাধু কর্মকর্তার কারণেই একটি বাহিনীর ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ