তিন যুক্তিতে সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স বাড়ানোর সুপারিশ করেছে সাবেক সচিব আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন কমিটি। তারা ছেলেদের ক্ষেত্রে ৩৫ বছর ও মেয়েদের ৩৭ বছর করার সুপারিশ করেছে।
এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। যে তিনটি কারণ চাকরিতে ঢোকার বয়স বাড়ানোর প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে তা হলো, মহামারি করোনাকাল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনীতির ক্ষত এবং নিকট অতীতে রাজনৈতিক কারণে বহু প্রার্থীর চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিল সরকার। গত সপ্তাহে এ কমিটি তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে।
কমিটিতে সদস্য সচিব হিসেবে ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. মোখলেস উর রহমান। সদস্য হিসেবে ছিলেন সাবেক যুগ্ম সচিব কওছার জহুরা, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইকবাল ও অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বর্তমানে পদোন্নতি পেয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব) সাইফুল ইসলাম।
চাকরিতে আবেদনের বয়স বাড়ানোর সুপারিশের যুক্তি হিসেবে প্রধান তিনটি কারণ উল্লেখ করেছে কমিটি। প্রথমত, করোনা মহামারিতে সরকারি চাকরির নিয়োগ বন্ধ ছিল। এই ক্ষতি পোষাতে গত সরকার বয়সে ছাড় দিলেও আটকে থাকা নিয়োগে তেমন গতি ছিল না। নতুন নিয়োগের উদ্যোগও ছিল কম।
দ্বিতীয়ত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় গত সরকার দেশের অর্থনীতি নিয়ে সমস্যায় ছিল। ফলে চাকরির সুযোগ সীমিত হয়ে এসেছিল। তৃতীয়ত, গত সরকারের মামলা-হামলার কারণে অনেক ছাত্র সংগঠনের হাজারো শিক্ষার্থী ঠিক সময়ে শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেননি। ফলে তারা চাকরি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি।
জানা গেছে, বয়স বাড়ানোর বিষয়ে তৃতীয় কারণটিই কমিটির কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। কারণ, এর রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। কমিটি সূত্র জানায়, রাজনৈতিক বিভিন্ন মহলের সুপারিশও ছিল চাকরির আবেদনের বয়স বাড়ানোর জন্য।
বিগত দিনে বিরোধী দলগুলো ও তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা সরকারি দল ও পুলিশের হামলা-মামলার কারণে নিজ বাড়িঘরেই থাকতে পারেননি। বয়স ৩০ পার হয়ে গেলেও অনেকে সরকারি চাকরিতে আবেদন করা সুযোগ হারান। রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিত সেই সব প্রার্থীর অধিকারের বিষয়টিও সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বয়স বাড়ানোর বিষয়টি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। এ সিদ্ধান্ত উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা করে নেওয়া হতে পারে। তাছাড়া চাকরির বয়স বাড়ানো হলে অনেক আইন-বিধি সংশোধন করতে হবে। তাই আইনগত দিকগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিতে আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও বৈঠক করতে হবে। তাই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বিষয়টি ওঠানোর আগে হয়তো আইনি দিকগুলো সম্পর্কে চূড়ান্ত করতে আরও অনেক উদ্যোগ নিতে হবে।
তবে কমিটির সুপারিশ গণমাধ্যমে আসার পর এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। একটি পক্ষ এই সুপারিশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের বক্তব্য হলো, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সেশনজটের কারণে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে বয়স ২৭-২৮ পেরিয়ে যায়। সুপারিশের বিরোধিতাকারীদের যুক্তি হলো, তারুণ্য পেরিয়ে মাঝবয়সে চাকরিতে এসে এই চাকরিজীবীরা দেশকে আর নতুন কিছু দিতে পারবেন না। তারা বলেন, একটি বিসিএস শেষ হতে আড়াই থেকে তিন বছর লাগে, তাহলে ৩৫ বা ৩৭ বছর বয়সে আবেদন করে আদতে তারা ৪০ বছরে এসে চাকরিতে যোগ দেবেন।
বর্তমানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ বছর। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য তা ৩২ বছর। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনে (বিজেএস) ও ডাক্তারদের আবেদনের বয়সসীমা ৩২ বছর। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকতায় ঢোকার বয়স ৩৫ বছর। আগে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ বছর। ১৯৯১ সালে তা বাড়িয়ে ৩০ বছর নির্ধারণ করা হয়।
সরকারি চাকরিজীবীরা বর্তমানে ৫৯ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করেন। এর পর অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে (পিআরএল) যান। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য এ বয়স ৬৫। উচ্চ আদালতের বিচারকরা ৬৭ বছর পর্যন্ত কর্মরত থাকেন। আগে সরকারি চাকরিতে অবসরের বয়স ছিল ৫৭ বছর পর্যন্ত। ২০১১ সালে বয়স দুই বছর বাড়িয়ে ৫৭ থেকে ৫৯ করা হয়।