ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘দলীয় রাজনীতি’ বন্ধ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট যে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি নিয়ে এখন নানা আলোচনা চলছে।
১৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে- পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের দলীয় রাজনীতি বন্ধ থাকবে। শুধু ছাত্ররা নয়, শিক্ষক-কর্মচারীরাও দলীয় রাজনীতি করতে পারবেন না।
সিন্ডিকেট সদস্যরা বিষয়টিকে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হিসেবে বর্ণনা করছেন।
সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক আবু হোসেন মুহম্মদ আহসান বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, পরে একটি কমিটি করে সবার সাথে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্র রাজনীতি থাকবে কি না এ প্রশ্ন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছে। এখন নতুন করে সিন্ডিকেট বৈঠকের ওই সিদ্ধান্ত এই আলোচনাকে আরো উস্কে দিয়েছে।
কিন্তু সব ধরনের ‘দলীয় রাজনীতি বন্ধ’ বলতে আসলে এখানে কী কী বোঝানো হয়েছে? এর মানে কি ক্যাম্পাসে কোনো মিছিল-মিটিং-সমাবেশ হবে না? ক্যাম্পাসে দলগুলোর নামে কোনো ছাত্র সংগঠন থাকতে পারবে না? নাকি তারা হলে কাজ করতে পারবে না? এর প্রয়োগ কিভাবে হবে?
আর দলীয় রাজনীতি যদি বন্ধ হয়েই যায়, তাহলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়করা তাদের ক্যাম্পাসভিত্তিক কার্যক্রম বহাল রাখতে পারবে কি? পারলেও তা কোন হিসাবে?
সভার সিদ্ধান্ত নিয়ে ধোঁয়াশা
উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর এবং কী কারণে এমন সিদ্ধান্ত এল, তা জানতে বিবিসি বাংলা থেকে আজ শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল।
তিনি তখন বলেন যে- সাংবাদিকরা তাদের বিভিন্ন সূত্র থেকে এই খবরটি পেয়েছে। কিন্তু যেহেতু এখনো তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা দেননি, তাই তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না।
‘এ বিষয়ে কিছু আলাপ-আলোচনা বাকি আছে। তাই এই মুহূর্তে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না। ঘোষণা দিলে বিস্তারিত বলতে পারবো। দুই এক দিনের মাঝে জানতে পারবেন,’ বলছিলেন তিনি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় থেকে সমন্বয়করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি, সভা-সমাবেশ করে আসছে। এমনকি, তাদের অনেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক বক্তব্যও দিচ্ছেন।
তাই, সমন্বয়কদের ব্যাপারে আলাদা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে কি না বা তাদের কর্মসূচিগুলোকে কোন আঙ্গিকে দেখা হবে, সে বিষয়েও এখনই কিছু বলতে রাজি হননি অধ্যাপক আহমেদ।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডেকেট ‘রাজনীতি বন্ধ বলতে আসলে কী বুঝাতে চেয়েছে, তা এখনো পরিষ্কার না’ তার কাছে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘এই ‘রাজনীতি বন্ধ’ তত্ত্বের মানে কী?’
সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত লিখিত আকারে দেখার আগ পর্যন্ত এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি তিনি।
বিষয়টি সম্বন্ধে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রো-ভিসিদের যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-ভিসি (প্রশাসন) সায়মা হক বিদিশা’র বরাত দিয়ে লিখেছে, রাজনীতির বিষয়ে সিন্ডিকেট সদস্যরা যে মতামত দিয়েছেন, সেগুলো পর্যালোচনা করে শিগগিরই একটি সারসংক্ষেপ বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হবে।
সভায় যা আলোচনা হয়েছে
গতকাল সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত পৌনে ৯টা পর্যন্ত সিন্ডিকেটের একটি জরুরি সভা হয়। সেখানে সিন্ডিকেটের ১৭ সদস্যের মধ্যে ১৫ জন অংশ নিয়েছিলেন।
তাদের মাঝে একজন হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু হোসেন মুহম্মদ আহসান। তার সাথে আজ আবারো কথা হয় বিবিসি বাংলা’র।
গতকালের আলোচনা সম্বন্ধে তিনি বলেন, ‘জাতীয় রাজনীতির সাথে জড়িত যেসকল দল আছে, তার ‘লেজুড়ভিত্তিক সংগঠনগুলোর রাজনীতি আপাতত বন্ধ’ থাকবে। এটাই আলোচনা হয়েছে।’
আহসান বলেন, বৃহস্পতিবারের আলোচনায় মিছিল-মিটিং ইত্যাদি বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়নি। যদিও বন্ধ থাকা মানে কিন্তু এগুলোই বুঝায়। শনিবার সিন্ডিকেট থেকে একটি প্রজ্ঞাপন বের হবে। সেখানে সব থাকবে।
‘বৃহস্পতিবারের সভায় এ কথা বলা হয়নি যে- ক্যাম্পাসে সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ। বিভিন্ন ফোরামে যারা ছাত্র শিক্ষক দাঁড়াচ্ছেন, এগুলোকে নিষিদ্ধ বা বন্ধ করার মতো কোনো আলোচনা কাল হয়নি বরং বলা হয়েছে, দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ,’ বলছিলেন তিনি।
তবে সমন্বয়কদের নিয়ে আলাদা করে আলোচনা হয়নি জনিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘তবে আমি যেটা বলতে পারি- তারাও যদি রাজনৈতিক দল গঠন করে, তাদের কর্মকাণ্ডও বন্ধ করার কথা। কোনো দল গঠন না করার পর্যন্ত তারা তাদের কর্মকাণ্ড চলমান রাখতে পারবে।’
সমন্বয়করা যা বলছেন
কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীরা যে নয় দফা দাবি দিয়েছিলেন, সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি নিষিদ্ধ করা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদারকে সিন্ডিকেট সভার ওই সিদ্ধান্তের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘যেহেতু অনেক রাতে এই সিদ্ধান্ত এসেছে, তাই আমরা এনিয়ে আলোচনা করতে পারিনি। তবে আমি যতদূর জানি, যদি এরকম কোনো সিদ্ধান্ত হয়ও, তাহলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোনো কর্মসূচি করবে না।’
এ প্রসঙ্গে কথা আরেক সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদের সাথেও। তিনি বলেছেন, ‘আমরা ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা বলছি না, দলীয় লেজুরভিত্তিক ছাত্র রাজনিতির বন্ধের কথা বলছি।’
তার একটি ‘পলিটিক্যালি কনশাস জেনারেশন’ (রাজনৈতিকভাবে সচেতন প্রজন্ম) চায় উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘কেউ যদি রাজনীতি করতে চায়, তাহলে পার্টি অফিসে গিয়ে করবে। ক্যাম্পাসের ভেতরে চলবে না। ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদভিত্তিক রাজনীতি থাকবে।’
এ বিষয়গুলো নিয়ে জানতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক- হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তাদেরকে পাওয়া যায়নি।
তবে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্তের খবর সম্মুখে আসার পর সারজিস আলম গতকাল তার ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে লিখেছেন, ‘নতুন এক বাংলাদেশ সৃষ্টির অগ্রযাত্রা শুরু হোক আজ থেকে…।’
সমন্বয়কদের সাথে অন্যদের পার্থক্য
অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলামের দৃষ্টিতে ‘সমন্বয়করা যা করছে, সেটা রাজনীতি-ই করছে।’
তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের সাথে তাদের কিছু ‘সূক্ষ্ম পার্থক্য’ রয়েছে।
‘অন্যদের সাথে ওরা যে পার্থক্য তৈরি করছে, তা হলো ওরা কোনো রাজনৈতিক দলের অংশ হিসাবে এটা করছে না। এই পয়েন্ট অব ভিউ থেকে তারা শিক্ষার্থীদের পক্ষ হয়ে এই মিছিল-মিটিং যা কিছু করছে, তা অ্যালাউড হচ্ছে।’
তবে তিনি মনে করেন যে- সম্বয়করা যেভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি করছেন, তা অন্যরাও করতে পারবে চাইলে।
‘ধরা যাক, ছাত্রদল কাল থেকে বললো যে আমরা ছাত্রদল, কিন্তু বিএনপি’র সাথে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা তো স্বাধীনভাবে করছি। এটা বলার সাথে সাথে বৈষম্যবিরোধী যে ছাত্র সংগঠন, তাদের সাথে ওদের কোনও পার্থক্য থাকবে না। ওরা যা করছে, ছাত্রদলও তখন তা করতে পারবে।’
যদিও অধ্যাপক ইসলাম মনে করেন, এভাবে কখনো ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা যায় না।
সিন্ডিকেট সভা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ওরা হয়তো বোঝাতে চেয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সম্পর্কযুক্ত কোনও সংগঠন, শিক্ষক, কর্মচারী, শিক্ষার্থী তাদের ব্যানারে কোনো কার্যক্রম করতে পারবে না। তাই, এখানে ‘রাজনীতি বন্ধ’ কথাটা বলার কোনো মানে নেই।’
‘জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় দলসমূহের সমর্থনে সম্পর্কযুক্ত কোনো সংগঠনের কার্যক্রম করা নিষেধ। এরকম কিছু বললে অর্থবহ। অন্যথায় এটা কিছু মিন করে না,’ তিনি যোগ করেন।
রাজনীতি বন্ধ করার প্রয়োজন কেন?
বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছাত্র রাজনীতি থাকলেও বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে তার তফাৎ আছে।
‘যুক্তরাষ্ট্রে ইয়াং ডেমোক্রেটস, স্টুডেন্ট ডেমোক্রেটস আছে। রিপাবলিকানদেরও আছে। ক্যাম্পাসে তারা ক্যাম্প করে, চ্যারিটি করে। ইলেকশনের সময় ক্যাম্পেইন করে। ভলান্টিয়ার হয়। এটা ইংল্যান্ড, এমনকি ভারতেও আছে। থাইল্যান্ডেও আছে,’ বলছিলেন অধ্যাপক ইসলাম।
তিনি মনে করেন, সমস্যা ছাত্র রাজনীতিতে না। ‘আমাদের এখানের ছাত্র সংগঠনগুলো বহু বছর ধরে একসাথে থেকেছে। ক্যাম্পাসে রাজনীতি করেছে, অসুবিধা হয়নি। সমস্যা তখনই হয়েছে, যখন জাতীয় রাজনীতি নষ্ট হয়ে গেছে। কারণ মূল পলিটিক্যাল পার্টিগুলো ঠিক ছিল।’
‘তারা ছাত্র সংগঠনগুলোকে ব্যবহার না করলে তো কোনো ক্ষতি ছিল না, তাদের সমস্যা তো রাজনৈতিক দলে। ছাত্র সংগঠনে না। পার্থক্য হল অন্যদেশে সেই ব্যবহারতা করে না, আমাদের দেশে সেটা করে,’ বলেন অধ্যাপক ইসলাম।
সূত্র : বিবিসি