21 C
Dhaka
Thursday, January 23, 2025

ট্রাইব্যুনাল ও দি*ল্লির যোগসাজশে সাঈ*দীর সাক্ষী গুম

দেলওয়ার হোসেন সাঈদী মামলার সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীকে ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর আইসিটি ট্রাইব্যুনালের গেট (পুরোনো হাইকোর্ট) থেকে অপহরণ করা হয়েছিল। আল্লামা সাঈদীকে কথিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে পূর্বনির্ধারিত সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করতে মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীকে সাক্ষ্য প্রদান থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় কথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারক- নিজামুল হক নাসিম, এ টি এম ফজলে কবির ও জাহাঙ্গির হোসেন।

সুখরঞ্জন বালী প্রসিকিউশনের (সরকার পক্ষের) সাক্ষী হলেও তিনি প্রসিকিউশন ও পুলিশের শেখানো জবানবন্দি দিতে অপারগতা প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন। তাকে নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছিল আওয়ামী বিচার বিভাগ। তাই ঝামেলা এড়াতে প্রসিকিউশন আদালতে তাকে নিখোঁজ ঘোষণা করে।

কিন্তু কথিত নিখোঁজ সুখরঞ্জন বালী হঠাৎ আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত হলে হাসিনার বিচারপতি এবং প্রশাসন ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়ে। তখনই বালীকে গুম করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

দেলওয়ার হোসেন সাইদিকে ১৯৭১ সালের বিসা বালী হত্যা মামলায় ফাঁসানোর পরিকল্পনা করেছিল ট্রাইব্যুনাল। বিসা বালীর ছোট ভাই সুখরঞ্জন বালী। তিনি জানান, সরকার পক্ষ থেকে তার ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছিল সাঈদির বিরুদ্ধে সাক্ষ দিতে।

এক পর্যায়ে তার স্ত্রী বলেন, সত্য কথা ট্রাইব্যুনালে গিয়েবলতে। এই প্রতিবেদক সুখরঞ্জনের গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরে তার বক্তব্য নিতে গেলে ১৯৭১ সালের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তিনি নিম্নোক্ত কথা বলেন:

২০১২ সালের ৪ নভেম্বরের ঘটনা। সেদিন ট্রাইব্যুনালের মাথায় হাত! তাদের বয়ান অনুযায়ী, নিখোঁজ সুখরঞ্জন বালী এসেছেন সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে। আল্লামা সাঈদীর আইনজীবীরা তাকে উপস্থাপনের চেষ্টা করলেন। নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল বললেন- সাক্ষী ক্লোজড, আজ নয়। আজ কোনো সাক্ষ্য নেওয়া যাবে না। ডিফেন্স আইনজীবীদের আপত্তির মুখে ট্রাইব্যুনাল আদেশ দিলেন, আগামীকাল (৫ নভেম্বর) নিয়ে আসেন।

এর মধ্যেই ট্রাইব্যুনাল পরিকল্পনা করে সুখরঞ্জন বালীকে কীভাবে সাক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত রাখা যায়। ট্রাইব্যুনালের পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে ট্রাইব্যুনাল গেট থেকে ওইদিনই অপহরণ করে সাদা পোশাক ও ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশের দল। বালীকে গুম করে প্রায় সাড়ে তিন মাস বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গুম রাখা হয়। তারপর পরিকল্পনা অনুযায়ী, দিল্লির সঙ্গে যোগসাজশে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

সুখরঞ্জন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ঘটনার বর্ণনা দেওয়া শুরু করি ট্রাইব্যুনাল অফিসারের সামনে, যা জানি সেটাই বলেছি। তাদের কাছে বলেছি, বাড়িতে পাকিস্তান আর্মিরা এসে আমার বড়ভাইকে মেরেছে। ভয়ে আমি আর আমার মা বাড়ির পাশে একটা বাথরুমে পালিয়ে ছিলাম। আমার ভাইকে কারা মেরেছে সবই দেখেছি। দেখলাম, পাড়া-প্রতিবেশী কিছু লোক ছিল এবং পাকিস্তান সেনারা ছিল।

তারা (ট্রাইব্যুনাল তদন্ত টিম) বলেছে, হুজুরের (সাঈদী) কথা বলতে। আমি হুজুরের কথা বলতে চাইনি। তাই তারা অনেক নির্যাতন করেছে এবং হুমকি দিয়েছে। আমি বলেছি, যাকে দেখি নাই, তার কথা বলব কেমনে। তারপরও তারা চেষ্টা করেছে আমাকে দিয়ে হুজুরের কথা বলাতে।’

সুখরঞ্জন বালীর ভাষ্য: গুম প্রসঙ্গ

প্রতিবেদকের প্রশ্ন : প্রথম দিন তো আপনার সাক্ষ্য নেয়নি। পরের দিন যখন সাক্ষ্য দিতে গেলেন, তখন কি ঘটেছিল?

সুখরঞ্জন : ‘কোর্টে যাওয়ার সময় গাড়িতে দুইজন ব্যারিস্টার ছিলেন। গাড়ি ট্রাইব্যুনালের কাছে যাওয়ার পর তারা গেট আটকে ফেলেছিল। যখন গাড়ি যেতে পারছিল না, তখন একজন ব্যারিস্টার নেমে বলেছে গাড়ি যাবে না কেন? তারা তখন বলে দরকার আছে। ব্যারিস্টার তখন তর্কবিতর্ক করছিল। এ অবস্থায় সাদা পোশাকাধারীরা আমাকে হাত ধরে নামাইছে। নামানোর পর আমি নিজেকে ছাড়ানোর জন্য খুব চেষ্টা করেছি। ব্যারিস্টার এবং উকিলও টানাটানি করেছে। এ অবস্থায় চতুর্দিকে সাদা পোশাকে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে।

তখন আর জোর করার কোনো কায়দা ছিল না। টেনে টেনে একটু সামনে রাস্তার পাশে নিয়ে পুলিশের ট্রাকে উঠাইছে। উঠানোর পর পরই চোখ আটকে দেওয়া হয়। চোখ আটকানোর পর কোথায় নিয়ে গেছে, সেটা আর বলতে পারব না। যেখানে রাখা হয়েছিল, সে জায়গাটা অন্ধকার। সামান্য একটু আলো আসত। দিন নাকি রাত সেটা আমি বলতে পারলাম না। ওখান থেকে বের করে মাঝে মাঝে নিয়ে কারেন্ট শক দেওয়া হতো। বলা হতো ঘটনার সঙ্গে হুজুরের নাম বলার জন্য। আমি বলতে রাজি হইনি। টাকার আর বাড়ির লোভও দেখিয়েছে।’

প্রশ্ন: ওখানে কত দিন রাখা হয়েছিল?

সুখরঞ্জন বালী: তিন মাস ১৩ দিন ছিলাম।

প্রশ্ন: ইন্ডিয়ায় কীভাবে গেলেন?

সুখরঞ্জন বালী: ডিবিতে হঠাৎ করে একদিন বলা হলো তোকে ছেড়ে দেব। কোথায় দিলে বাড়ি যেতে পারবি? তখন বলেছি, বাগেরহাটের যে কোনো জায়গায় দিলে বাড়িতে যেতে পারব। একদিন সকালে চোখ বেঁধে গাড়িতে ওঠানো হয়। সারাদিন চোখ বাঁধা অবস্থায় ছিল। এ অবস্থায় গাড়ি চলছে। খাওয়া-দাওয়া কিছুই নাই। ফেরি পার হওয়ার সময় বুঝতে পারছিলাম, নদী পার হচ্ছি। ফেরি পার হয়ে আবার গাড়ি চলতে থাকল। অনেক দূর গিয়ে গাড়ি থামাইছে। তখন বুঝতে পারি নাই কোথায় থামাইছে। চোখ বাঁধাই ছিল। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দিল। গাড়ি থেকে নেমে দেখি সামনে দুইজন বিডিআর। বাগানের মতো ছিল। কিছুক্ষণ হাঁটার পর দূরে দেখলাম বিএসএফ বসা আছে।

প্রশ্ন: কোথায় ছিল জায়গাটা?

সুখরঞ্জন বালী: বৈকারি বর্ডার, স্বরূপনগর থানা। বর্ডারের কাছাকাছি গিয়ে ডিবি ও বিডিআর বলে সামনে যা। যাইতে না চাইলে বলে যেতেই হবে। আমার দুই হাত ধরে জোর করে সামনে নিয়ে বিএসএফের হাতে তুলে দেয়।

প্রশ্ন: বিএসএফের হাতে দেওয়ার সময় কি বলেছিল?

সুখরঞ্জন বালী: কী বলেছিল, এটা তো আর বুঝিনি। হিন্দিতে কথা বলেছিল। বুঝতে পারি নাই।

প্রশ্ন: বিএসএফ আপনাকে নিয়ে কি করল?

সুখরঞ্জন বালী: দেওয়ার সাথে সাথে তারা মাইর শুরু করেছিল। মারতে মারতে পাকা রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল। লাথি দিছে, লাঠি দিয়েও মারছে।

মারার পর বিএসএফের অফিসে নিয়া রাখছে। তারপর রাত ১২টারও পর থানায় দিছে। থানায় রাখছে রাতে।

প্রশ্ন: থানায় দেওয়ার পর কি ঘটল?

সুখরঞ্জন বালী: থানা থেকে পরের দিন বশিরহাট কোর্টে নিয়েছে। সেখান থেকে একটা জেলে পাঠাইছে। সেটা বশিরহাট জেল ছিল। বশিরহাট জেলে রাখার পর আমি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ি। বশিরহাটে ২২ দিন রাখার পর দমদম কারাগারে পাঠিয়েছিল। দমদম কারাগার থেকে ১৪ দিনের মাথায় আবার বশিরহাট কোর্টে আনা হয়। কিন্তু কোর্টে কখনো ওঠানো হতো না। ম্যাজিস্ট্রেট, জজ এসব দেখি নাই। গারদে রেখেই আবার ফেরত নিত। এভাবে ৪৫ বার আনা-নেওয়া করা হয়েছিল।

প্রশ্ন: বাংলাদেশ থেকে যারা আপনাকে গাড়িতে করে নিয়ে গিয়েছিল, এটা কারা ছিল?

সুখরঞ্জন বালী: তারা ডিবির লোক ছিল। ডিবির লোক বর্ডারে নিয়ে গেছে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখানে কারা আটক রেখেছিল?

সুখরঞ্জন বালী: বাংলাদেশে আটক রাখছিল ডিবিরা। যেখানে রাখছিল, সে জায়গাটা দিনরাত কিছুই বোঝা যেত না।

প্রশ্ন: দমদম কারাগারে কত বছর ছিলেন?

সুখরঞ্জন বালী: ওখানে পাঁচ বছর ছিলাম।

প্রশ্ন: বাড়িতে আত্মীয়স্বজনকে জানাতে পেরেছিলেন দমদম কারাগারে যাওয়ার পর?

সুখরঞ্জন বালী: না। তিন বছর পর্যন্ত কারোর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। আমার পরিবারও জানত না কোথায়, কীভাবে আছি।

প্রশ্ন: পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হলো কেমন করে?

সুখরঞ্জন: তিন বছর পর দমদম কারাগারে দূরসম্পর্কের এক ভাগনের সাথে দেখা হয়েছিল। তাকে তখন বললাম, তুই তো বাংলাদেশে যাবি। আমার একটা সংবাদ বলতে পারবি। তখন দাড়ি মোচ ছিল। চেহারা চেনা যেত না। ও আমাকে দেখে চিনতে পারে নাই। তখন ওর কাছে গিয়ে হাত ধরে বলি- ও শিশির, তুই আমার দিকে ফিরে চা। বলে তুমি কেডায়। বললাম, তুমি চেন না বাবা আমারে, আমি অমুক। তখনই বলে আরে মামা তুমি এখনো আছ। তোর কথা তো শুনছি, তোরে মাইরা ফালাইছে। আমরা তো পেপার-পত্রিকায় দেখছি, তোমারে মাইরা ফালাইছে। বললাম, বাবা মরি নাই, আছি। বাড়িতে যাইয়া তোর মামিকে বলবি, অমুক জায়গায় মামা আছে। শেষ পর্যন্ত শিশির দমদম থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়িতে আইয়া সংবাদ পৌঁছাইছে।

প্রশ্ন: পরিবার জানার পর কী পদক্ষেপ নিয়েছিল?

সুখরঞ্জন বালী: ওই দেশেও আমার আত্মীয়স্বজন আছে। তাদের সাথে যোগাযোগ করেছে পরিবার।

প্রশ্ন: আমরা জানতে পেরেছিলাম, আপনি ওই দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন।

আরও পড়ুনঃ বাংলা*দেশের প্রস্তাবে সরাসরি না করে দিয়েছে সৌ*দি আরব
সুখরঞ্জন বালী: ওই দেশে আমার আত্মীয়স্বজন আছে তো। তারা ওই দেশের কাগজপত্র বের করে মানবাধিকার সংস্থাকে দিয়েছে। এরপরই সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে আমার জন্য দরখাস্ত করেছিল।

প্রশ্ন: আপনি বলেছেন, বিএসএফ বর্ডারে আপনাকে মারছে। এটা কি ইন্ডিয়ার কোর্টে বলেছিলেন?

সুখরঞ্জন বালী: বলমু কার কাছে! কোর্টে তো উঠাইতো না। কারাগার থেকে কোর্টে আনলেও জজ-ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নিত না।

প্রশ্ন: কারাগার থেকে বের হলেন কেমন করে?

সুখরঞ্জন বালী: মানবাধিকার সংস্থা যদি সুপ্রিম কোর্টে আমার পক্ষে না যাইত, তাহলে বের হয়ে আসতে পারতাম না। মানবাধিকার সংস্থা আমাকে বের করেছে।

প্রশ্ন: কারাগার থেকে বের হয়ে সরাসরি বাংলাদেশে এসেছিলেন?

সুখরঞ্জন বালী: দমদম থেকে বের হওয়ার পর মানবাধিকার সংস্থার গাড়ি দিয়ে বর্ডার পার করে দিয়েছিল। এরপরই বাড়ি আসার সুযোগ হয়েছিল।

প্রশ্ন: আপনাকে কোর্টের সামনে থেকে উঠিয়ে নিয়ে গুম করার জন্য বিচার চেয়ে কোনো মামলা করবেন?

সুখরঞ্জন বালী: আমারে ধরে নিয়ে গুম করার জন্য আমি বিচার চাইব। পাঁচ বছর আমার পরিবার জানত না আমি কোথায়। মুক্তিযুদ্ধে ভাই মারা গেল আমার। কেন আমাকে নির্যাতন করা হইল। এটার বিচার আমি চাইমু।

উঠিয়ে নেওয়ার সময় প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা:

প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবীদের বর্ণনা:

সুখরঞ্জন বালীকে ৫ নভেম্বর (২০১২) ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যাচ্ছিলেন ডিফেন্স টিমের সিনিয়র আইনজীবী মিজানুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট মো. হাসানুল বান্না সোহাগের গাড়িতে করে। চালকসহ মোট চার জন ছিলেন ওই গাড়িতে।

অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করে ওইদিনের ঘটনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা প্রতিদিনের মতোই ট্রাইব্যুনালে যাচ্ছিলাম। কোনোদিন গেটে আমাদের গাড়ি থামায়নি। ওইদিন ছিল একটু অস্বাভাবিক অবস্থা। গেটসহ সব জায়গায় ছিল বাড়তি নিরাপত্তা। পুলিশ ছিল সতর্ক পাহারায়। সাদা পোশাকে ডিবির উপস্থিতি ছিল অনেক বেশি। এরকম পরিস্থিতি আগে কোনোদিন ছিল না। গেটে যাওয়ার পর হঠাৎ করে গাড়ি থামায় পুলিশ। তিনি জানান, পুলিশের কাছে জানতে চাওয়া হলো, কেন থামানো হলো? জবাবে বলা হয়েছিল, উপরের নির্দেশ আছে। এ সময় দরজা খুলে সোহাগ (আইনজীবী) গাড়ি থেকে নেমে পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করে। দরজা খোলার পরই সাদা পোশাকে ডিবির লোক সুখরঞ্জন বালীকে টেনে নামিয়ে নিয়ে যায়।

মো. হাসানুল বান্না সোহাগ। যিনি পরিস্থিতি বুঝতে গাড়ি থেকে নামার চেষ্টা করছিলেন। তার সঙ্গে দেখা করেও প্রত্যদর্শী হিসেবে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, গাড়ি থেকে নামার জন্য দরজা খোলা মাত্রই ডিবির লোকজন ঘিরে ফেলে। তারা গাড়িতে উঁকি দিয়ে দেখে সুখরঞ্জন বালী বসা। তাকে টেনে নামিয়ে নেয়। তিনি আরো জানান, তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। উত্তরে বলা হয়, তার সঙ্গে কথা আছে। একটু কথা বলতে হবে। তিনি বলেন, তখন মনে করেছিলাম কথা বলে ছেড়ে দিবে। কিন্তু তারা সুখরঞ্জন বালীকে নিয়ে কোর্টে প্রবেশ গেটের দিকে যাচ্ছিলেন। তখন পুলিশ দুইদিক থেকে তার হাতের ডানা ধরে রাখে। আমিও তার একহাত ধরে সঙ্গে হাঁটতে থাকি। একটু আগানোর পর সাদা পোশাকে পুলিশের সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। কোর্টের প্রবেশ গেট পার হওয়ার সময় এক রকম টানাটানি। আমার চেষ্টা ছিল, যাতে কোর্ট গেটের বাহিরে না নিতে পারে। তবে তাদের সঙ্গে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। কোর্ট গেট পার হওয়ার পর তারা কার্ড দেখিয়ে বলে আমরা প্রশাসনের লোক। আপনি চলে যান। নতুবা আপনাকেও নিয়ে যেতে বাধ্য হব। এরপর আর কিছুই করার ছিল না তখন। একপর্যায়ে সামনে থেকে একটা গাড়ি আসে। দ্রুত এটাতে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়।

এ নিয়ে যা ঘটেছে নিজামুল হকের ট্রাইব্যুনালে:

ট্রাইব্যুনালের কর্মকাণ্ড:

বর্তমান ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। তিনি তখন ডিফেন্স টিমের সিনিয়র আইনজীবী। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছির সেদিন বিষয়টি নিয়ে ট্রাইব্যুনালে কি ঘটেছিল।

অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম জানান, সুখরঞ্জন বালীকে যে গাড়িতে করে কোর্টে নিয়ে আসা হচ্ছিল, সেই গাড়ির ড্রাইভার মোবাইলে ঘটনার কিছু ছবি তুলেছিলেন। সুখরঞ্জন বালীয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এবং পুলিশ গাড়িতে ওঠানোর সময় কয়েকটা ছবি তুলেছিলেন পেছন থেকে। এই ছবি দ্রুত প্রিন্ট করে দৌড়ে ট্রাইব্যুনালে গেলাম। গিয়ে ঘটনা জানানো হলো। বলা হলো, ডিফেন্সের সাক্ষীকে ট্রাইব্যুনাল গেট থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনাল প্রথমে বিষয়টিকে পাত্তাই দিতে চায়নি। তাজুল ইসলাম জানান, একপর্যায়ে ডিফেন্স টিমের আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালে বিষয়টি নিয়ে জোরালোভাবে বলেন। তখন নিজামুল হক নাসিম তৎকালীন প্রসিকিউশন টিমের প্রধান গোলার আরিফ টিপুকে বিষয়টি খোঁজ নিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দিতে বললেন। ঘণ্টাখানেক পর গোলাম আরিফ টিপু এসে জানায়, এ ধরনের কোনো ঘটনা ট্রাইব্যুনাল গেটে ঘটেনি।

আরও পড়ুনঃ ফেস*বুক স্ট্যাটাসে ৩ দাবি ঘোষণা করলেন হাস*নাত আব্দুল্লাহ
তাজুল ইসলাম আরও জানান, তখন জোরালো দাবি জানানো হয়েছিল, ট্রাইব্যুনাল গেটের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে কোর্টে পরীক্ষা করার জন্য। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিম কিছুক্ষণ পর জানালেন, তিনি সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেছেন। এ ধরনের কোনো ঘটনা খুঁজে পাননি সিসিটিভিতে।

অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, এ ঘটনার জন্য ট্রাইব্যুনালকে দায়ী করেন কি না? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি সরাসরি বলেছিলেন, অবশ্যই এ ঘটনার জন্য দায়ী ট্রাইব্যুনাল। এটার জন্য ট্রাইব্যুনাল রেসপন্সিবিলিটি নিতে হবে। এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে নিজামুল হক নাসিম আদালত অবমনার নোটিশ ইস্যু করেছিলেন তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে। এ নোটিশের শুনানির পর তাজুল ইসলামকে তিন মাসের জন্য ট্রাইব্যুনালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।

অ্যাডভোটেক তাজুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, সুখরঞ্জন বালীকে অপহরণের জন্য নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনাল পুরোপুরি দায়ী। দিনের আলোতে সবার সামনে ঘটনা ঘটেছে। সেদিন সকাল থেকে ট্রাইব্যুনালের আশপাশে শত শত পুলিশ মোতায়েন ছিল। এমন দৃশ্য এর আগে কখনো দেখা যায়নি। ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা ও পরিকল্পনা ছাড়া এমনটা হয়নি। পরে আর কোনোদিন এমন নিরাপত্তা নেওয়া হয়নি। সুতরাং এটা স্পষ্ট ট্রাইব্যুনাল পরিকল্পনা করেই এই ঘটনা ঘটিয়েছিল।

দীর্ঘ ১২ বছরেও শুনানি হয়নি সুখরঞ্জনকে নিয়ে দায়ের করা রিট:

নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনালে কোনো সুরাহা না পেয়ে পরের দিনই হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট আবেদন করে সুখরঞ্জন বালীর সন্ধান চাওয়া হয়েছিল। এজন্য হাইকোর্টের নির্দেশনার আবেদন করা হয়েছিল রিটে। কিন্তু সেই রিট হাইকোর্ট বিভাগ শুনতে গড়িমসি করে। তখন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক হাইকোর্ট বিভাগে নাঈমা হায়দারের দ্বৈত বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানি করেছিলেন। তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের কড়া আপত্তির একপর্যায়ে কোনো আদেশ না দিয়ে রিট আবেদনটি ফেলে রাখা হয়।

এ প্রসঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি নাসিম

নিজামুল হক নাসিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে। এ প্রতিবেদক ফোন করেন তার কাছে। ফোন রিসিভও করেন তিনি। পরিচয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে থমকে যান। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলেন, আমি অনেক দিন আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলি না। আমি কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলব না।

জাহাঙ্গির হোসেন বললেন, এখন আমার এ বিষয়ে কিছু বলা ঠিক হবে না-

সেদিন ট্রাইব্যুনালে বিচারকের আসনে ছিলেন জাহাঙ্গির হোসেন। তার সঙ্গে দেখা করে সুখরঞ্জন বালী অপহরণের সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল জড়িত থাকার প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তার সামনে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, সেদিন বালীকে অপহরণের পর ট্রাইব্যুনালে আবেদন করা হয়েছিল সিসিটিভি ক্যামেরা দেখতে। এছাড়া বিষয়টি জানানোর পর চিফ প্রসিকিউটরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল খোঁজ নিয়ে জানাতে। ঘণ্টাখানেক পর চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু এসে জানালেন, এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। সিসিটিভি পরীক্ষা না করে গোলাম আরিফ টিপুর বক্তব্য মোতাবেক ট্রাইব্যূনাল বিষয়টি ইগনোর করেছে। এতে কি প্রমাণ হয় না যে ট্রাইব্যুনাল জড়িত ছিল? তখন তিনি বলেন, অনেক দিন আগের ঘটনা। অনেক কিছুই আমার স্মরণে নাই। যদিও আমি এখন অবসরপ্রাপ্ত, তারপর এ বিষয়ে এখন আমার কিছু বলা ঠিক হবে না।

বালীকে ভারতের বিএসএফের কাছে হস্তন্তরের বিষয়ে জানতে চেয়ে হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারির কাছে মেসেজ পাঠানো হয়েছিল। এ মেসেজের উত্তর পাওয়া যায়নি।

সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ