চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে লাভজনক ও অত্যাধুনিক নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশের একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিল নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা, বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের নির্দেশে এ লক্ষ্যে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। তবে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ‘আত্মঘাতী’ এই সিদ্ধান্ত থেকে মন্ত্রণালয় সরে এসেছে।
এখন দাবি উঠেছে, দেশীয় প্রতিষ্ঠান বা অপারেটরকেই ওপেন টেন্ডারের (ওটিএম) মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক দরে দীর্ঘমেয়াদে এই টার্মিনাল পরিচালনার ভার দেওয়া হোক। এতে সরকার যেমন কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করবে, তেমনি মানবসম্পদ উন্নয়ন ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনসহ দেশ বহুভাবে উপকৃত হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করে। ১ হাজার মিটার দৈর্ঘ্য ও ২৬ হেক্টর প্রস্থের (ব্যাকআপ ফ্যাসিলিটিজসহ) এই টার্মিনাল ২০০৭ সালে চালু হয়। সেই থেকে অদ্যাবধি এনসিটিতে হ্যান্ডলিং কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
এনসিটিতে মোট পাঁচটি বার্থ রয়েছে-যেখানে সমুদ্রগামী জাহাজ ভেড়ানো হয়। এর মধ্যে একটি বার্থ পানগাঁও টার্মিনালের জন্য সংরক্ষিত রাখা হলেও বাকি চারটি বার্থ ওপেন টেন্ডার করা হয়। দুটি বার্থ সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড এককভাবে পায়। অপর দুটি বার্থ এমএইচ চৌধুরী ও এএন্ডজে নামে দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে পায়।
২০১৫ সাল থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে তারা বার্থগুলো পরিচালনা করে। বন্দরের সিসিটি (চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল) আগে থেকেই অপারেটিং করত সাইফ পাওয়ার টেক। এনসিটি সিসিটির ব্যাকআপ ফ্যাসিলিটিজ হিসাবে ব্যবহার করা হতো। এনসিটি প্রথমে ডিপিএম পদ্ধতিতে পরে ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে পরিচালনার দায়িত্ব পায় সাইফ পাওয়ারটেক। বর্তমানে এনসিটির পুরোটাই হ্যান্ডলিং করছে এই টার্মিনাল অপারেটর।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে টেন্ডারের মেয়াদ শেষ হলেও নানা জটিলতায় নতুন করে টেন্ডার করতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। মেয়াদ শেষে ডিপিএম (ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড) পদ্ধতিতে বিদ্যমান অপারেটরদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য নিয়োগ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেবা যাতে বন্ধ না হয় সেজন্যই এটি করা হয়। অপারেটর হ্যান্ডলিংয়ের দর বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সময়ে আবেদন করলেও সেই আবেদন বিবেচনা করেনি বন্দর।
২০১৯ সালে এনসিটির জন্য আবার দরপত্র আহ্বান করলে একাধিক প্রতিষ্ঠান এই টেন্ডারে অংশ নেয়। হঠাৎ করেই মন্ত্রণালয় থেকে এনসিটির এই টেন্ডার বাতিল করে দেওয়া হয়। এটি বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে মন্ত্রণালয়। এজন্য গঠন করা হয় ‘কেবিনেট কমিটি অব ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স’ কমিটি।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ও মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্র জানায়, মূলত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা, বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের ‘কু-নজর’ পড়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর।
মন্ত্রণালয় ও বন্দরের বেশির ভাগ শীর্ষ কর্মকর্তা রাজি না থাকা সত্ত্বেও তাদের বাধ্য করা হয় টেন্ডার বাতিলে। বিদেশি কোম্পানির হাতে কিভাবে এনসিটি তুলে দেওয়া যায় সে লক্ষ্যে কাজ শুরু করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সরকার পতনের কয়েক সপ্তাহ আগেও এ নিয়ে একটি বৈঠক হয় বলে বন্দর সূত্র জানিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, এনসিটি বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এজন্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটিও গঠন করেছিল।
প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপ (পিপিপি) অথরিটি বিষয়টি দেখছে। তবে সরকার পতনের পর এ বিষয়ে পরবর্তী আর কোন সিদ্ধান্ত বা অগ্রগতি আমাদের জানানো হয়নি। বিদ্যমান টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক এই টার্মিনালে অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন এর চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘একটি টার্মিনাল স্মুথলি চলছে। অথচ সেটি বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত শুরু করে সরকারেরই নীতিনির্ধারকরা। এটি খুবই দুঃখজনক ঘটনা। সৌদি আরবকে খুশি করার জন্যই একটি টার্মিনাল ইতোমধ্যে দিয়ে দেয়া হয়েছে।
মূলত যারা এসব করছেন, বিদেশিদের হাতে বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম বা টার্মিনাল হ্যান্ডলিং কার্যক্রম তুলে দিতে চান তারা হচ্ছেন ‘হিডেন পার্টনার’। বিদেশিদের সামনে দিয়ে নিজেরাই লুটেপুটে খাওয়ার জন্য এসব চক্রান্ত করে। কেবল চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি নয়; সরকারের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের ক্ষেত্রে এটি হয়ে থাকে। শুরু থেকেই চট্টগ্রাম বন্দর আমাদের দেশের অপারেটররাই পরিচালনা করছেন।
তা হলে এখানে বিদেশিদের দরকার কী। প্রযুক্তিগত কোনো ঘাটতি থাকলে, দক্ষতার ঘাটতি থাকলে দেশের মানব সম্পদকে স্কিল করা, বা প্রযুক্তির ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে। তাই বলে বিদেশি কোম্পানির কাছে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বন্দরের কোন টার্মিনালই তুলে দেওয়া সমীচীন হবে না। আমি এ ধরনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানাব।
এনসিটির কার্যক্রম : চট্টগ্রাম বন্দরের বৃহত্তম টার্মিনাল এনসিটির ধারণক্ষমতা ১ দশমিক ১ মিলিয়ন টিইইউএস (২০ ফুট সমমানের কনটেইনার)। সাইফ পাওয়ারটেক তা ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন টিইইউএস এ উন্নীত করে। এনসিটির জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ দুই হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনেন। সেই ধারাবাহিকতায় ১৪টি রেল মাউন্টেন্ট কী গ্যান্টি ক্রেন, (কিইউজিসি) ২৯টি রাবার টায়ার গ্যান্ট্রি ক্রেন (আরটিজি) কেনা হয়। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংযুক্ত করার কারণে বন্দরের উৎপাদনশীলতা অনেক বেড়ে যায়। বন্দর কর্তৃপক্ষ আমদানি-রপ্তানির ৫৫ শতাংশ কার্গো হ্যান্ডলিং করে বছরে এক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে তিন হাজার ৮২০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। দক্ষতার সঙ্গে হ্যান্ডলিং কার্যক্রম পরিচালনা করায় প্রতি মাসে বন্দর প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। সাইফপাওয়ার ২০০৭ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে ১৩ হাজার ৭৩০টি জাহাজ হ্যান্ডলিং করেছে। কেবল এনসিটিতেই জাহাজ হ্যান্ডলিং করেছে আট হাজার ২২১টি। একই সময়ে কেবল এনসিটিতে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ১ কোটি ১৪ লাখ ৪৩ হাজার ৭৩৯টি।
২০০৭ সালে যেখানে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থান ছিল ১০ থেকে ১২ দিন। সেখানে ২০২৩-২৪ সালে এসে জাহাজের গড় অবস্থান দাঁড়িয়েছে ২ থেকে ৩ দিনে। অর্থাৎ একটি জাহাজ কনটেইনার বা পণ্য নিয়ে বিদেশ থেকে এসে তা খালাস করে সর্বোচ্চ তিন দিনের মধ্যে আবার পণ্য নিয়ে ফিরে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরের সর্ববৃহৎ টার্মিনাল এনসিটির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। বিশ্বের বন্দরগুলোর র্যাংকিং তালিকায়ও ৬৭তম অবস্থান ধরে রেখেছে চট্টগ্রাম বন্দর।
সূত্র: যুগান্তর