রাষ্ট্রের ছয়টি ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করবে অন্তবর্তীকালীন সরকার। সংস্কারের জন্য গঠিত ছয়টি কমিটি আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ভিত্তিতে শুরু হবে আলোচনা।
রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষও সংস্কার বিষয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরতে পারবেন। এ ছাড়া জুলাই-আগস্টের গণহত্যা মামলার বিচার শুরু হলে বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় ভারতে আশ্রয় নেওয়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রধানদের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো তুলে ধরেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এ সময় নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমও বক্তব্য দেন।
বৈঠকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। স্বচ্ছতা নিশ্চিত এবং সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা তৈরিতে উপদেষ্টা পরিষদের সব সদস্য ও সমপদমর্যাদাসম্পন্ন সব ব্যক্তির সম্পদের হিসাব বিবরণী প্রকাশের জন্য এ-সংক্রান্ত নীতিমালার খসড়াও অনুমোদন পেয়েছে বৈঠকে।
নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন এবং সংবিধান সংস্কারের জন্য গঠিত ছয় কমিটির প্রধানদের সঙ্গে গতকালই প্রথম বৈঠকে বসেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। বৈঠকে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী বৈঠকে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ ভার্চুয়ালি বৈঠকে যুক্ত হন।
এ ছাড়া সরকারের পক্ষে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে আসিফ নজরুল বলেন, বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের জন্য গঠিত ছয়টি কমিশন আগামী ১ অক্টোবরের মধ্যে কাজ শুরু করবে। এসব কমিশন আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে। কমিশনে যারা প্রধান হিসেবে আছেন, তারা কীভাবে কাজ করতে চান, সদস্য বাছাই কীভাবে করা হবে, কর্মপদ্ধতি কী হবে, রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনগুলোর এনগেজমেন্ট কীভাবে হবে, সে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছি।
তিনি আরও বলেন, আশা করছি সংস্কার কমিটির প্রধানরা আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবেন। প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য উপদেষ্টারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবেন। যারা বিচারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হবে না। এ ছাড়া অন্য সবার সঙ্গে আলোচনা করা হবে। আমরা জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যেই সরকার আসবে সেও এক ধরনের জনগণের মালিকানা অনুভব করতে পারে। এর আগে যেসব কমিশনের রিপোর্ট হয়েছে সেগুলোও বিবেচনায় নেওয়া হবে জানিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন অনলাইনে উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে যেখানে সবার মতামতকে রিফ্লেক্ট করার চেষ্টা করা হবে।
আরও সংস্কার কমিশন গঠন করা হবে জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেন ওই সংস্কার কমিশনগুলো এই সংস্কার কমিশনের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করবে না। প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন থেকে দেশে ফেরার পর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গে কমিশন কাজ শুরু করবে। এসব কমিশনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে কিছু কিছু কাজ তাৎক্ষণিকভাবে করা হবে, কিছু কিছু কাজ মধ্যমেয়াদি, কিছু কাজ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে করা হবে। কিছু কিছু প্রস্তাব হয়তো আগামী সরকারের জন্য রাখা হবে।
শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে:
শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানোর বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে আসিফ নজরুল বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের এক্সট্রাডিশন ট্রিটি আছে। সে অনুযায়ী ভারতে যদি আমাদের কনভিকটেড মানুষ থাকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী হন আর যাই হোন, ওনার প্রত্যার্পণ আমরা চাইতেই পারি। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সময় যেসব গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে সেসবের বিচারে প্রসিকিউশন টিম গঠন করা হয়েছে, আদালত পুনর্গঠনের চিন্তা চলছে, অচিরেই আপনারা দেখতে পাবেন বিচার শুরু হয়েছে, বিচার শুরু হওয়ার পর আমরা (শেখ হাসিনার) প্রত্যর্পণ চাইব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিটিয়ে হত্যার যে ঘটনা ঘটেছে সেটি আমাদের সবাইকে মর্মাহত করেছে, খুবই কষ্ট দিয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি, তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই ধরনের ঘটনা এড়ানোর জন্য যত রকম পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন আমরা তত রকম পদক্ষেপ নেব। মব জাস্টিস, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া, গণপিটুনি দেওয়া তথা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই একসেপ্ট করা হবে না। এগুলো ঘটলে সরকার তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেবে এবং আইনের মাধ্যমে তদন্ত করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য এসব কমিশনের কার্যক্রম এবং কাদের নিয়ে কমিশন গঠন করা হবে সেসব বিষয়ে ধারণা পাওয়া গেছে। আমাদের রিপোর্টের মাধ্যমে উনারা কি আশা করছেন সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমার সঙ্গে যে কথা হয়েছে, কমিশন হবে অবৈতনিক, এটা না হলে আমি এই প্রস্তাব গ্রহণ করতাম না।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, কমিশনগুলোর প্রস্তাবনের আলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। কমিশনগুলো কোন কোন ক্ষেত্রে কাজ করবে এবং কারা কারা এর সদস্য হিসেবে আসবে তা শিগগিরই জানতে পারবেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাদেশের অনুমোদন:
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট তৃলে ধরে বলা হয়েছে, সরকারের ক্ষমতা ও দায়িত্ব, প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাগণের পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা, পদত্যাগ এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে বিধান করা জরুরি। এমন প্রেক্ষাপটে উপদেষ্টা পরিষদ ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে।
উপদেষ্টাদের সম্পদের হিসাব বিবরণী প্রকাশ হবে:
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা এবং সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালার খসড়া প্রণয়নপূর্বক উপদেষ্টা পরিষদ-বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা এবং সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ যারা সরকার অথবা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত, তারা প্রতিবছর আয়কর জমা দেওয়ার সর্বশেষ তারিখের পরবর্তী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে নীতিমালায় সংযুক্ত ছকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার নিকট তাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার বিধান রেখে খসড়া ‘আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা’ উপদেষ্টা পরিষদ-বৈঠকে অনুমোদিত হয়।